বাংলাদেশে জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুর জন্য একমাত্র খাবার হওয়া উচিত মায়ের দুধ- এমনটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ দীর্ঘদিন ধরে সুপারিশ করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা ও স্বাস্থ্য জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশে মাতৃদুগ্ধপান করা শিশুর হার ক্রমেই কমছে, যা নবজাতক ও শিশুদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস ২০২৫ উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম (বিএনএফ) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইসিএমএইচ) পরিচালক, বিএনএফ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান এ কথা জানান।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি উপস্থিত ছিলেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক খুরশিদ আলম। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক যায়যায়দিনের বিশেষ প্রতিনিধি এ কে এম সাখাওয়াত হোসেন।

বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক সুফিয়া খাতুন, উপদেষ্টা, বিএনএফ, অধ্যাপক লায়লা আর্জুমান্দ বানু, সভাপতি, বিপিএস, অধ্যাপক মোঃ মনির হোসেন, প্রাক্তন সভাপতি, বিএনএফ, অধ্যাপক মোঃ আব্দুল মান্নান, মহাসচিব, বিপিএস। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মো: মাহবুবুল হক, সভাপতি, বিএনএফ।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সালে যেখানে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত একচেটিয়াভাবে মায়ের দুধ পান করত প্রায় ৬৪% শিশু, সেখানে ২০২২ সালে এ হার নেমে আসে ৫৫%-এ। অর্থাৎ এক দশকে প্রায় ৯ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে মাতৃদুগ্ধপানের হার। সম্প্রতি আট বিভাগের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জন্মের প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ পায় গড়ে ৪৯ শতাংশ শিশু।

সংবাদ সম্মেলনের মুখ্য বক্তা অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান বলেন, একচেটিয়াভাবে মায়ের দুধ পান করানো কমে গেলে শিশু অপুষ্টি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে জন্মের পর প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে স্তন্যপান না করালে মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।

তার মতে, মায়ের প্রথম দুধ শিশুর জন্য প্রাকৃতিক টিকা হিসেবে কাজ করে। এতে থাকে অ্যান্টিবডি, প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল যা নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া শিশুর বৃদ্ধি ও মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে। ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস ও স্থুলতা হওয়ার ঝুঁকি কমায়।

অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান জানান, মাতৃদুগ্ধপানের হার কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। এরমধ্যে প্রথমে রয়েছে শিশুখাদ্য শিল্পের আগ্রাসী বিপণন। বাজারে পাওয়া ফর্মুলা মিল্ক ও প্যাকেটজাত দুধের বিজ্ঞাপন অনেক মাকে বিভ্রান্ত করছে।

দ্বিতীয়তঃ মাতৃত্বকালীন ছুটি কম হওয়ার কারণে মাতৃদুগ্ধ পানের হার কমেছে। সরকারি চাকরিজীবীদের ছুটি তুলনামূলক দীর্ঘ হলেও বেসরকারি খাতে তা মাত্র ৩-৪ মাস, ফলে মায়েরা আগে থেকেই দুধের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হন।

এছাড়া প্রসূতি মা ও পরিবারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতিসহ পর্যাপ্ত সহায়তার অভাবে মাতৃদুগ্ধ পানের হার কমছে।

বিএনএফ’র সভাপতি অধ্যাপক মো: মাহবুবুল হক বলেন, বাংলাদেশে যদি সকল শিশু জন্মের পর প্রথম ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ পেতে শুরু করে এবং ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মাতৃদুগ্ধপান করে, তাহলে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার নবজাতকের মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

বিএনএফ’র উপদেষ্টা অধ্যাপক সুফিয়া খাতুন বলেন, মাতৃদুগ্ধপানের হার বাড়াতে হলে- বেসরকারি খাতে অন্তত ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা; সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে স্তন্যদান কর্ণার স্থাপন; শিশুখাদ্য বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণে কড়া আইন প্রয়োগ; গর্ভাবস্থা থেকেই মায়েদের পুষ্টি ও স্তন্যপান বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও পরিবার ও কর্মস্থলে স্তন্যপান-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।

বিপিএস মহাসচিব অধ্যাপক মোঃ আব্দুল মান্নান, শিশুর জন্য মায়ের দুধের বিকল্প নেই। এটি শুধু খাদ্য নয়, এটি জীবনরক্ষাকারী প্রতিষেধক। যে দেশ যত বেশি মাতৃদুগ্ধপান নিশ্চিত করতে পারে, সে দেশের শিশুমৃত্যুর হার তত কম।

মাতৃদুগ্ধের বিকল্প হিসেবে কৌটাজাত গুড়ো দুধ খাওয়ানোর জন্য জন্য উৎসাহ দেওয়ার অপরাধে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা ও সাজা দেওয়ার বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ অপতৎপরতা বেড়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বক্তারা।