বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের প্রকৃত ফায়দা তখনই পাবেন, যখন ইসলামকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবেন। শুধু যাকাত প্রদান করলেই সমাজের সকল সমস্যা সমাধান হবে না, ইসলামের অন্যান্য মৌলিক বিধানও মেনে চলতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি সৎ ও মানবিক সমাজ গঠনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, মানুষের রচিত আইনকানুনের কারণে যে বৈষম্য, জুলুম ও শোষণ সৃষ্টি হয়েছে এগুলো থেকে সমাজকে বের করে এনে সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্য জীবন এবং ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা নিশ্চিত করে যাকাত। সে কারণে যাকাত ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বাংলাদেশে যত ধনী আছে তারা যদি যাকাত দেন তাহলে আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশে একজনও দরিদ্র থাকবে না। সবাই যাকাতদাতা হয়ে যাবে। আমাদের সমাজ যাকাতকে বর্জন করে গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাচেতনার ওপর গড়ে উঠার কারণে সমাজের মানুষের শোষণ বঞ্চনা দূর হচ্ছে না। যাকাত ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু না হলে এটা দূর করা সম্ভবও হবে না। তিনি বলেন, প্রচলিত পুঁজিবাদী ও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার কারণে সমাজে বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনা বেড়েছে। অথচ যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করা হলে সমাজের শোষণ ও দারিদ্র্য দূর হবে এবং ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ। শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রাতে খুলনা মহানগরী জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে নগরীর আল ফারুক সোসাইটিতে অনুষ্ঠিত যাকাত ও উশর শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ সব কথা বলেন।

কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ও খুলনা মহানগরী আমীর অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ মসজিদ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মীর মঞ্জুর মাহমুদ, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক। কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ও মহানগরী সেক্রেটারি এডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলালের পরিচালনায় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. অ. ছ. ম. তরীকুল ইসলাম। এ সময় মহানগরী নায়েবে আমীর অধ্যাপক নজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি এডভোকেট শাহ আলম, প্রিন্সিপাল শেখ জাহাঙ্গীর আলম ও আজিজুল ইসলাম ফারাজী, হাফেজ মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক প্রমুখ।

সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মানুষের একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আগামীতে যদি সৎ লোকের নেতৃত্ব নিয়ে আসা যায়, তাহলে তারাই যাকাত ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সমাজে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই কাল কিয়ামতে আমরা সফল হবো। আর যদি আমাদের চেষ্টায় ত্রুটি থাকে, তাহলে কাল কিয়ামতে আমরা ধরা খাবো। কুরআনের জন্য এই রোযার মাসের এতো গুরুত্ব। কুরআন না থাকলে রোযার কোন গুরুত্ব থাকতো না। কুরআনের মধ্যে সকল বিধি বিধানের কথা উল্লেখ রয়েছে। তাই কুরআনের বিধান মোতাবেক আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে হবে। যাকাতের মাধ্যমে সকল শ্রেণীর খারাপ মানুষকে সঠিক পথে নিয়ে আসাও একটা বড় কাজ।

অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি চালু না হলে এদেশে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না। যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি চালু করতে হলে ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব না। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তিনি সংগঠনের বিত্তবান ব্যক্তিদের সঠিক নিয়মে যাকাত ও উশর প্রদান করার আহ্বান জানান।

মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক বলেন, ইসলামের ৫টি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় হচ্ছে যাকাত। মাহে রমযানের শুরুতেই যাকাত আদায়ের মাধ্যমে আমাদের সম্পদকে পবিত্র করতে হবে। যাকাত ফরয হয় নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে, সেক্ষেত্রে সম্পদের হিসাব থেকে ২.৫% যাকাত আদায় করতে হবে। যাদের ফসলের উপরে আয় রয়েছে তাদেরকে উশর আদায় করতে হবে। সম্পদের উপরে দুই ধরনের যাকাত রয়েছে, একটা বস্তুগত সম্পদ এবং অন্যটি ফসলী উৎপাদনের উপরে। নিসাবের দু’টি মানদন্ড আছে, স্বর্ণ ও রূপার ক্ষেত্রে। যাকাত আদায়ের অর্থ হচ্ছে আমার সম্পদকে পবিত্র করা। সম্পদশালীদের জন্য দু’টি অন্যতম ফরয বিধান যাকাত ও হজ্ব পালন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ৮টি নির্দিষ্ট খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে হবে। সমাজসেবা বিভাগের মাধ্যমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যাকাত দাতাদের কাছ থেকে যাকাত আদায় ও বন্টনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করছে।

প্রফেসর ড. মীর মঞ্জুর মাহমুদ

বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি সফল ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে এবং যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে তখন রাষ্ট্রের কাছে এই যাকাত আদায় ও বন্টণের দায়িত্ব ন্যস্ত হবে। তখন যাকাত ব্যবস্থাপনা সরকার-ই সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে এবং পাওনাদাররা সুষ্ঠুভাবে এই যাকাত থেকে তাদের প্রাপ্য বুঝে পাবেন। যাদের মালে নিসাব আছেন প্রত্যেককে যার যার আয়ের হিসাব থেকে যাকাত আদায় করতে হবে। শুধুমাত্র পিতার আয়ের উপর নয়, পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যক্তিগত আয়ের উপরেও যাকাত প্রদান করতে হবে। যাকাত দিলে মাল পবিত্র হয় এবং বারাকাহ বা প্রবৃদ্ধি বাড়ে। যাকাত আদায় না করে নিজে খেয়ে অনেকে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। পবিত্র কুরআনে যেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে নামাযের কথা বলা হয়েছে, সাথে সাথেই যাকাত আদায়ের কথাও সেখানে বলা হয়েছে। সকল সম্পদের উপরে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে। অন্যদিকে ফসলের উপরেও উশর দিতে হবে। প্রাকৃতিক নিয়মে বৃষ্টি মারফত যদি ফসল হয় তাহলে ১০ ভাগের ১ ভাগ উশর আদায় করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, আজকে ইসলামী রাষ্ট্র নেই। যাকাত ভিত্তিক যাকাত ব্যবস্থা চালু করতে হলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রয়োজন। তাই যাকাত ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব। সংগঠনের সমাজকল্যাণ তহবিলে যাকাতের টাকা দিয়ে সমাজের দুস্থ, বেকার লোকজনকে কর্মসংস্থান করে দিয়ে আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সে কাজে সকলের সহযোগী কামনা করেন তিনি।

এদিকে খুলনার খানজাহান আলী থানাধীন ঐতিহ্যবাহী গিলাতলা দক্ষিণপাড়া ইসলাম প্রিয় তৌহিদী জনতার উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী (১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি) ৫১ তম বার্ষিক ঐতিহাসিক আমিনিয়া ইছালে ছওয়াব ও তাফসিরুল কুরআন মাহফিলের প্রধান অতিথি ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। তৃতীয় অর্থাৎ সমাপনী দিনে সভাপতিত্ব করেন নওয়াপাড়া পীর সাহেব হযরত মাওলানা রফিকুজ্জামান শাহ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ফুলতলা আইয়ান জুট মিলস্ লি. ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফেরদৌস হোসেন ভূঁইয়া। মাহফিলে আলোচনা পেশ করবেন ভারতের বশিরহাটের পীর সাহেব হযরত মাওলানা শরফুল আমীন, ঢাকার মুক্তির জ্ঞান ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুস সামাদ আজাদ, রাজশাহী বায়তুন নাজাত জামে মসজিদের খতিব হাফেজ ক্বারী হযরত মাওলানা মুস্তাক আহমাদ, গিলাতলা বাইতুন নূর জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মুফতী আবুল বাশার জিহাদী, ভারত থেকে আগত বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিত হযরত মাওলানা জাহিদুল ইসলাম বৈদ্যর এবং দিঘলিয়ার লাখোহাটির বিশিষ্ট আলোচক হযরত মাওলানা মনিরুল ইসলাম গাজীপুরী। ঐতিহাসিক এই মাহফিলে সকলের দৃষ্টিকাড়ে রাজধানী দারুল কুরআন হিফজ মাদরাসার ছাত্র ও দারুল কুরআন সাংস্কৃতিক সংসদের সহযোগী সদস্য মো. সিয়াম আলীর ইসলামী সংগীত। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বক্ততা করেন মাহফিল বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. একলাস উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল ইসলাম, মসজিদ কমিটির সহ সভাপতি সাংবাদিক সাইফুল্লাহ তারেক।