ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর শিক্ষার্থীরা সরাসরি ভোট দিয়ে সিনেট সদস্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চায় ফিরে এল। এই নির্বাচনে ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রায় ৭০-৭৫% শিক্ষার্থী সরাসরি ভোট দিয়ে অংশগ্রহণ করে। এই প্রজন্মের ঢাকা ইউনির ভোটারদের জন্য এটা ছিলো তাদের জীবনের প্রথম নির্বাচন, যা তাদের জীবনের একটা অবিস্মরণীয় দিন। ফেসবুক বিষয়ে একটি পোস্টে বিস্তারিত লিখেছেন সাবিনা আহমেদ নামের এক নারী।

সাবিনা আহমেদ ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের পর গতকালের ডাকসু নির্বাচন ছিলো বাংলাদেশে সংগঠিত হয়ে যাওয়া প্রথম নির্বাচন, যাতে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ৭০-৭৫% শিক্ষার্থী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। এই প্রজন্মের ঢাকা ইউনির ভোটারদের জন্য এটা ছিলো তাদের জীবনের প্রথম নির্বাচন, যা তাদের জীবনের একটা অবিস্মরণীয় দিন।

ওদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ১৯৯০ সালে থেকে ব্যান হওয়া শিবির, ৩৫ বছর পর ঢাবিতে ফের উন্মুক্ত রাজনীতিতে ফিরে আসে। শিবির গঠিত হয়েছিল শহীদ জিয়ার আমলে, ১৯৭৭ সালে, ঢাবির মসজিদে। এরশাদের পতনের পর, ঢাবির অথরিটি এবং ছাত্র প্রতিনিধিদের প্ল্যাটফর্ম ‘পরিবেশ পরিষদ’ শিবিরের রাজনীতির উপরে ব্যান আরোপ করে। এই ব্যান বিএনপি এর আমলেও বলবৎ ছিলো, ফলে দশকের পর দশক শিবির ঢাবিতে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারেনি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনকালে।

তিনি লেখেন, জাতীয়ভাবে, শিবিরকে ২০২৪ সালের ১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ব্যান করে (অ্যান্টি-টেররিজম আইনের অধীনে), কিন্তু ইন্টারিম সরকার ২৮ আগস্ট এই ব্যান তুলে নেয়। এর পর থেকে শিবির ঢাবিতে আবার প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে অনুমতি পেয়েছে, এবং ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে তাদের নেতারা ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে উপস্থিত হয়। ব্যান হওয়ার ৩৫ বছর পর ঢাবির ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ শিবিরের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ আর পরীক্ষা ছিলো। যাতে তাদের অভূতপূর্ব জয় হয়েছে; কিন্তু এর পিছনে আছে তাদের মেধা, পরিকল্পনা, আর পরিশ্রম।

তারা কেন জয়ী হলো:

১) ঢাবির ভোটাররা মূল ধারার রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ তাদের ভার্সিটির জীবনে প্রত্যাখ্যান করেছে। যেখানে শিবির তাদের নিজেদের প্রার্থী জামায়াতের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে বাছাই করেছে, সেখানে ছাত্রদলের প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি এর ভারপ্রাপ্ত দলীয় প্রধান তারেক জিয়া। যা ঢাবির শিক্ষার্থীদের কাছে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা পুরোনো ধারার রাজনীতি হিসেবে বিবেচিত, মূলত জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর এই ধারার রাজনীতিকে ছাত্র-জনতা প্রত্যাখ্যান করছে।

২) শিবির, শিবির হিসেবে না দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়েছে ছাত্র-ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট হিসেবে। এই প্যানেলে হিজাবি-ননহিজাবি, বিভিন্ন ধর্মের লোকদের অন্তর্ভুক্তি সত্যিই একটা শক্তিশালী দিক। এটি তাদেরকে “সম্প্রসারিত” করে দেখিয়েছে, যা জুলাই বিপ্লবের পরের “ঐক্যের” মেজাজের সাথে মিলে যায়। এটা করায় তাদের দুটো সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়নি। এক, শিবির নারীবান্ধব, নারী বিরুদ্ধ নয়, সাদিক কায়েমকে ক্যাম্পাসে নারীদের সাথে হাসিমুখে কথায় বলতে দেখা গেছে বহু ভিডিওতে, তাদের সাথে নিয়ে মিটিং করতে দেখা গেছে বহু প্রচারের ভিডিওতে; শিবিরের কাছে নারীদের বোরখা পরা বাধ্যতামূলক নয়; দুই, তারা কেবল ইসলামভিত্তিক নয়, বরং তাদের দুয়ার সবার জন্য খোলা। ঢাবির মেয়েদের কাছে শিবির প্যানেলের অসম্ভব গ্রহণযোগ্যতা আছে।

৩) অন্যান্য প্যানেলের মধ্যে বিভক্তি (যেমন লেফট-সেন্টার, রিয়েল লেফট, দুটো এনসিপি প্যানেল, বিএনপি প্যানেল) তাদের ভোট ছড়িয়ে দিয়েছে, ভোট বিভক্তির কারণে লেফট এবং সেক্যুলার গ্রুপগুলোর ভোট ৪-৫ ভাগে ছড়িয়ে পড়েছে। যা শিবির শিবিরই ছিলো, যেই একতার সুবিধা তারা পেয়েছে।

৪) যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামায়াতের অতীত ইতিহাস আছে, তাই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক পদটি শিবিরের কাউকে না দিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের জুমাকে দিয়ে সেই পদটির ব্যাপারে সকল সমালোচনা তারা দূরে ঠেলে দিয়েছে।

৫) শিবিরের ক্যাম্পেইন মূলত পজিটিভ ছিল—তারা ছাত্রদের অধিকার, ক্যাম্পাস উন্নয়ন এবং ঐক্যের উপর ফোকাস করেছে, নেগেটিভ অ্যাটাক কম করেছে। যেখানে ছাত্রদল, বাগছাস, বামদল মূলত নেগেটিভ ক্যাম্পেইন করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই নেগেটিভ ক্যাম্পেইন প্রত্যাখ্যান করেছে।

৬) জুলাই বিপ্লবের পর ছাত্ররা এখন দলীয় লেবেলের বিরুদ্ধে। ট্যাগিং কালচার এখন বাতিল, গত জুলাইতে ছাত্র-জনতা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, যার ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের রাজাকার ডেকে (তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার) রাস্তায় নেমে হাসিনাকে বিদায় করেছে। এসবের পরেও ছাত্রদল, বাগছাস, আর বামদলগুলোর ট্যাগিং ( পাকিস্তান-রাজাকার) কে তাদের ক্যাম্পেইনে র মুল বার্তা রেখেছিল। স্বভাবতই ঢাবি শিক্ষার্থীরা ফের তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে শিবিরের কোনও ভোট কাটা যায়নি।

৭) ঢাকা ইউনির ভোটাররা শিক্ষিত, তাদের বিচার-বিবেচনা এভারেজ নয়। তারা হোমওয়ার্ক করে এসে কে তাদের জন্য ভালো হবে তা বুঝে ভোট দিয়েছে। এদের ভোট প্রত্যাখ্যান করা মানে ভবিষ্যতে ঢাবিতে রাজনীতি করার উপর প্রশ্ন তোলা। তাই যারা এখন ভোটার রেজাল্ট প্রত্যাখ্যান করছে বা এ নিয়ে নেগেটিভ বার্তা দিচ্ছে তারা নিজ নিজ দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছে। এই নির্বাচন হচ্ছে ছাত্র রাজনীতির লিটমাস টেস্ট।

৮) বাংলাদেশের জনজীবনে বামদের কোনো স্থান নেই। তারা সবসময় গঠনমূলক নয় বরং বিভক্তির রাজনীতি করে। একদিকে তাদের নেগেটিভিটি, ইসলামফবিয়া, অন্যদিকে এলিটিস্ট এটিচ্যুড তাদের সাধারণ জনগণ থেকে দূরে ঠেলে দেয় । মধ্যপন্থীরাও বামদের প্রত্যাখ্যান করে। ফলে স্বভাবতয় তাদের ভোট শিবির পেয়েছে। এই দেশে যারাই বামে যাবে, তারাই বিভক্ত হবে, তারাই পচবে, তারাই হারবে।

৯) সবচেয়ে বড় পয়েন্ট হচ্ছে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষ ডান দিকে ঝুঁকে গেছে। মেয়েদের হিজাব বাড়ছে, যা সমাজের কনজারভেটিভ টিল্ট দেখায়। জুলাই বিপ্লবের পর ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট বেড়েছে। সেখানে বাম দলকে বাদই দিলাম, খোদ বিএনপি বাম দিকে সরে গেছে। জনগণ যখন ডানে, তখন রাজনৈতিক দল বামে সরলে, জনগণ অবশ্যই জনবান্ধব ডানপন্থী দলের দিকেই ঝুঁকবে, তাকেই ভোট দেবে; আর তাই ঘটেছে গতকাল ডাকসুতে। জয়ী হয়েছে শিবিরের ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট।

এই নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির “পয়েন্টার”। এই নির্বাচন আমাদের দেখিয়েছে মানুষ ৭১ নিয়ে গর্বিত, কিন্তু তা নিয়ে রাজনীতি করতে আর ইচ্ছুক নয়। ৭১ আর ২৪ আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জড়িয়ে আছে, কিন্তু তা দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করতে আমরা আগ্রহী নই। আমরা কাজ করতে আগ্রহী, নিরাপত্তায় আগ্রহী, দেশ গঠন আর উন্নয়নে আগ্রহী। দুনিয়া অনেক এগিয়ে গেছে, আমাদের অনেক এগুতে হবে। আমাদের সন্তানদের একটি সুন্দর দেশ উপহার দিতে হবে।

শিবিরের ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, তোমাদের অভাবনীয় জয়ের জন্য শুভকামনা। এই জয়কে শোকে পরিণত হতে দিয়ো না, যেই প্রতিজ্ঞা করে শিক্ষার্থীদের মন জয় করেছো, তা পূরণ করার যুদ্ধে নেমে পড়ো। নিজেদের হিউমিলিটি বজায় রেখ। নাহলে এই আমরাই তোমাদের সমালোচনা করতে দ্বিধা করব না।

অল দ্য বেস্ট, ঢাকা ইউনিভার্সিটি!