আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে একটি সুপরিচিত নাম। বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং জোটনির্ভর রাজনীতির প্রবর্তন এবং চারদলীয় জোটের প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক অবদান রাখার জন্য আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ রাজনীতি সচেতন মানুষের নিকট একজন গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। জোটের রাজনীতির প্রবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কেননা এর মাধ্যমে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে একই প্লাটফর্মে আনা সম্ভব হয়েছে। এর পাশাপাশি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। মন্ত্রী হিসেবেও তিনি একজন সৎ মানুষ হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের দশম শাহাদাত বার্ষিকী আজ। ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে নাজিমউদ্দিন রোডস্থ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। একই সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়।

এর আগে রাত ৮টার পরই দুই পরিবারের সদস্যদেরকে ডেকে পাঠান কারা কর্তৃপক্ষ। রাত ৯টার পর কারাগারে গিয়ে পৃথকভাবে মুজাহিদ ও সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। রাত ১০টা ৫০ মিনিটে সাক্ষাৎ শেষে কারাগার থেকে বেড়িয়ে আসেন সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার। তারা বের হয়ে আসার পরই কারাগারে প্রবেশ করেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পরিবার। সাক্ষাৎ শেষে ১২টা ২৫ মিনিটে তারা কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। দুজনের পরিবারের সদস্যরাই জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি বরাবর তারা কোন ধরনের আবেদন করেননি।

ওই দিন বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করার আবেদন নিয়ে কারাগারে যান তার আইনজীবী। কিন্তু কারাকর্তৃপক্ষ তার আবেদন গ্রহণ করেননি।

যুদ্ধাপরাধের ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বিচারে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে অভিযোগ জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দিতে গিয়ে বিফল হয়ে ফিরেছে তার পরিবার। আইনি সব প্রক্রিয়া নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদ- কার্যকরের তোড়জোড়ের মধ্যে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই চিঠি দেয়ার কথা জানান বিএনপি নেতার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী।

২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এরপর ১ অক্টোবর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং তা কারাকর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর ২ অক্টোবর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সাথে রিভিউ আবেদন দায়েরের বিষয়ে পরামর্শ করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার পাঁচজন আইনজীবী সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষতে তিনি আইনজীবীদের রিভিউ আবেদন দায়ের করার পরামর্শ দেন।

১৭ নভেম্বর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও ১৮ নভেম্বর সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে ১৮ নভেম্বরই তা খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। একদিন পরই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওই দিনই তা কারাগারে পৌছে।

২০১০ সালের ২৯ জুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার একটি মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে তাকে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এরপর ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ফাঁসির আদেশ দেয় আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে অপর দুই সদস্য বিচারপতি মো: মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক শাহিনুর ইসলাম।

এ দিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে হরতালে গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুরের এক মামলায় গ্রেফতার করা হয়। এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী: বর্ষিয়াণ রাজনীতিবিদ আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি। তিনি তার পিতা, প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুল আলীর কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। একজন ধর্মীয় নেতা ও আধ্যাত্মিক পুরুষ হিসেবে মাওলানা আব্দুল আলীকে আজও ফরিদপুরসহ গোটা অঞ্চলের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তিনি শুধু ধর্মীয় নেতাই ছিলেন না বরং জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৬২-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন।

পরবর্তীতে, মুহতারাম আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ফরিদপুর ময়জুদ্দিন স্কুলে ভর্তি হন এবং তারও পরে তিনি ফরিদপুর জেলা স্কুলে অধ্যয়ন করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা সুসম্পন্ন করার পর তিনি ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রী শেষ করার পর তিনি ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আগমন করেন। জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাত্র দুই-আড়াই মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ক্লাস করার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় মুহতারাম মুজাহিদ আর সেখানে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।

ছাত্র রাজনীতি: ছাত্র জীবন থেকেই এুহতারাম মুজাহিদ রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। শুরুতে রাজেন্দ্র কলেজে কিছুদিন এনএসএফ এ কাজ করার পর তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সাথে যুক্ত হন। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে যখন তিনি ফরিদপুর ছাড়েন তখন তিনি ফরিদপুর জেলায় ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৭১ সালের জুলাইতে ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সেক্রেটারি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মনোনীত হন এবং এর মাত্র দুই মাস পর অক্টোবরে তিনি ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচিত হন।

প্রাথমিক কর্মজীবন: আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ তার পেশাগত জীবন শুরু করেন নারায়ণগঞ্জ আদর্শ স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে। এর আগে ১৯৭৩-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই আদর্শ স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। স্কুলের জন্য আর্থিক সংস্থান ও ছাত্র সংগ্রহে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তার ঐকান্তিক চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের কারণে আদর্শ স্কুল আজও নারায়ণগঞ্জ জেলায় সর্বশ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জের আদর্শ স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে সাংগঠনিক প্রয়োজনে তিনি ঢাকায় স্থানান্তরিত হন। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি দৈনিক সংগ্রামের চেয়ারম্যান এবং সাপ্তাহিক সোনার বাংলার পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন। গ্রেফতার হওয়ার কিছু দিন পূর্বে তিনি ’রাইজিং সান’ নামক একটি ইংরেজি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছিলেন।

জামায়াতে যোগদান: ছাত্রজীবন শেষ করার পরপরই আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। তিনি ১৯৮২-১৯৮৯ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরী জামায়াতের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা : আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বরাবরই দেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও ছাত্র আন্দোলনে, ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, ১৯৯৪-১৯৯৬ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, ২০০০ সালে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলনে এবং ২০০৭ সালে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর পাশাপাশি, জনগণের মৌলিক সমস্যা ও জাতীয় সমস্যা নিরসনেও তিনি সক্রিয় অবদান রাখেন।

মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন : আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং মন্ত্রী হিসেবে সফলতার সাথে ৫ বছরের মেয়াদ সম্পন্ন করেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন সময়ে তিনি মাদারীপুর জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

সামাজিক কার্যক্রম : নিঃস্বার্থ একজন সমাজ সেবক হিসেবে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ব্যাপক সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দেশজুড়ে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ ও এতিমখানা বিনির্মাণে তার সক্রিয় ভূমিকা জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। তার নিজ জেলা ফরিদপুরে তিনি ৫০ টিরও বেশি মসজিদ নির্মাণে ভূমিকা পালন করেন। দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি এই ব্যাপক সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। মাদরাসা ছাত্রদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে ২০০২ সালে তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকার ফাজিলকে বিএ সমমানের এবং কামিলকে মাস্টার্স মানে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মাণেও তার ভূমিকা সক্রিয় ছিল। তার প্রচেষ্টা ও দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে ফরিদপুর ও মাদারীপুরের মত অবহেলিত জেলা দুটিতে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হয়। অগণিত রাস্তা, সড়ক ও মহাসড়ক, মাদরাসা, ব্রীজ, কালভার্ট ও মসজিদ এই সময় এই এলাকাগুলোতে নির্মিত হয়। তিনি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় বিভাগীয় সমাজ সেবা কেন্দ্র এবং হাজী শরীয়তউল্লাহ ব্রীজ উদ্বোধন করেন। মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে মোহাম্মদ মুজাহিদ দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি নিয়মিতভাবেই তার মন্ত্রণালয়ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সারপ্রাইজ ভিজিটে যেতেন। এর মাধ্যমে তিনি মন্ত্রণালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি কমানোর চেষ্টা করেছেন এবং তাতে তিনি অনেকটা সফলও হয়েছেন। তার মেয়াদে তিনি বাংলাদেশের ৬৪ টি জেলায় ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক শিশু সদন (সরকারি এতিমখানা) নির্মাণ করেন। যা সমাজের ভাগ্যহত ও অনগ্রসর কিশোর কিশোরীদের উন্নয়নের মূল ¯্রােতধারায় নিয়ে আসতে ব্যপকভাবে সাহায্য করে।

২০০১ সালে যখন আলী আহসান মোহাম্মমদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন, তখন তা একটি দুর্বল বা লো প্রোফাইল মিনিস্ট্রি হিসেবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু তার ৫ বছরের মেয়াদের শেষে এটি হাই প্রোফাইল তথা আলোচিত মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়। মন্ত্রণালয়ের বাজেট মাত্র ৫ বছরে ৫ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। এগুলো সবই হয় মন্ত্রী হিসেবে তার একনিষ্ঠা ও সফলতার কারণে। তিনি তার মন্ত্রিত্বের ৫ বছরে ছোট খাট নানা অনুষ্ঠান ছাড়াও ৪০টিরও বেশি আলোচিত প্রোগ্রাম করেন যেখানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যোগ দেন। তার নেতৃত্বে ২০০৪ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রতিবন্ধী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ’মুক্তা’ নামক একটি মিনারেল ওয়াটারেরও প্রবর্তন করেন। যা প্রতিবন্ধীদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত এবং বাজারজাতকৃত। তার এই উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশের নাম তখন বিশ্ব দরবারে ভিন্নভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। তার সময় প্রতিবন্ধী অলিম্পিকেও বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করে। এছাড়া সুদ মুক্ত ঋণ ও এসিডদগ্ধদের মধ্যে ব্যপকভাবে ভাতা প্রদান করা হয় তার সময়ে। মুহতারাম মুজাহিদ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ঘুরে ঘুরে নিজে এই ভাতা বিতরণ করতেন। তাই তার সময়ে গ্রামের অভাবী মানুষ সুদখোর মহাজন এবং বেসরকারি সংস্থার হাত থেকে মুক্ত হয়ে সরকারের কাছ থেকে বিশেষত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হাত থেকে ঋণ নিতে শুরু করে। কিন্তু পরবর্তীতে এই উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলো বন্ধ হয়ে যায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে।

বৈবাহিক অবস্থা: আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর বেগম তামান্না-ই-জাহানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তামান্না-ই-জাহান একজন গৃহিণী এবং পড়ুয়া মানসিকতার একজন নারী যিনি নিয়মিতভাবে পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন।

মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন ৩ পুত্র ও এক মেয়ে সন্তানের সম্মানিত পিতা।

আমীরে জামায়াতের আহ্বান : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের অবদানের কথা স্মরণ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বৃহস্পতিবার দেয়া বিবৃতিতে বলেন, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ইসলামী আন্দোলনের এক আদর্শনিষ্ঠ ও আপসহীন নেতা ছিলেন। দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার, ভোটাধিকার এবং ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার বলিষ্ঠ ভূমিকা যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

তিনি আরো বলেন, শহীদ আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে একদিন এ দেশে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। জাতি আজ গভীরভাবে তার শূন্যতা অনুভব করছে। তিনি মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মহান রাব্বুল আলামীন আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের শাহাদাত কবুল করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চতম স্থান দান করুন। তার অসমাপ্ত কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য তিনি জামায়াতে ইসলামীর সর্বস্তরের জনশক্তির প্রতি আহ্বান জানান ও দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।