সচেতন নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীরা জানিয়েছেন বাংলাদেশের নিরাপদ ভবিষ্যৎ গঠন, জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় আকাঙ্ক্ষা বিষয়গুলো নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
শুক্রবার (২৩ মে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশ ২.০-জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা প্রস্তাবনা শীর্ষক’ সেমিনারে আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
সেমিনারের আয়োজন করে ‘নেক্সাস ডিফেন্স অ্যান্ড জাস্টিস (এনডিজে)’। সেমিনারে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা : বাংলাদেশের নিরাপদ ভবিষ্যৎ গঠনে দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা হয়। বক্তারা আলোচনায় জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় আকাঙ্ক্ষা, বাংলাদেশের নিরাপত্তা নীতি প্রণয়নে ভূমিকা ও অবদান অপরিহার্য বিষয়টি তুলে ধরেন।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ‘দেশের সব সমস্যা তখনই সমাধান হবে, যখন আমরা সবাই সৎ হব। বিগত সরকার দেশের সকল মানুষ ও প্রতিষ্ঠান কর্তাদের সৎ থাকতে দেয়নি। নৈতিকতা হারিয়ে গেলে সেই জাতিকে ফিরে আনা কঠিন। অর্থনৈতিক কাঠামো নষ্ট হলে পরিশ্রম করে সেটি ফিরে আনা যায়। আর শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট হলে আর ফেরানো সম্ভব নয়। শিক্ষার্থী নেই অনেক জায়গায় অনার্স কোর্স চালু করেছে।’
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘ভারত পাকিস্তানে আক্রমণ করতে সাতবার ভাবে। পাকিস্থানের আছে আধুনিক অস্ত্র, আছে সামর্থ্য। তবে আমাদের কি আছে? তবে বন্ধু খুঁজতে হবে, যে কেউ হামলা করলে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে কথা বলবে, এমন বন্ধু দরকার। তাহলেই আমাদেরকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেবে ভারত।’
ভারতের বর্তমান আচরণ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘ভারত মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিল, আমি মুক্তিযুদ্ধ গিয়েছিলাম, এখন কী তাদের আচরণ দেখলে মনে হয়, তারা আমাদেরকে সাহায্য করতে চেয়েছিল? তাদের দরকার ছিল পাকিস্তানকে ভাঙার। এক পশ্চিম পাকিস্তান নিয়েই বিপদে ভারত, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান থাকলে কি হতো? তারা পাকিস্তান ভাঙতে চেয়েছিলেন, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। স্বাধীনতা যদি চাইতো, তাহলে আজকে কি এই অবস্থা হয়? ৫ তারিখে কি হয়েছিল? একটা সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, এ দেশের সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, তাতে ভারতের কি? ভারত সরকারের কি তাতে? ওই সরকার চলে গেছে, জনগণের সরকার আসবে। তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখবে। ভারত মনে করে আওয়ামী লীগের পতন মানে তাদের পতন হয়েছে। চিন্তা করা যায়? এই প্রেক্ষাপটে, বিজেপির সাথে কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব অথচ সব এক হয়ে গেল। আগস্টে আওয়ামী লীগের পতন হলে ভারতের কি? এখনো তারা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে।’
আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম, তাদের মধ্যে কঠোর ঐক্য রাখতে হবে। ঐক্য থাকতেই হবে, কেউ চামড়া কেটে নিতে পারে, আঙ্গুল কেটে নিতে পারে, সবশেষে তারপরও আসো বন্ধু, আমাদেরকে এক জায়গায় হতে হবে। তা না হলে এই ষড়যন্ত্রের কাছে আমরা হেরে যাব।’
সভাপতির বক্তব্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাসান নাসির (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, ‘জাতির নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিরক্ষা সুরক্ষা নিয়ে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশকে বাঁচাতে ও টিকিয়ে রাখতে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা অতীব জরুরি। এটা মন দিয়ে আমাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে। কি কারণে, কি প্রয়োজনে আমরা এই নীতিমালা চাই। বাস্তবায়নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কথা বলতে হবে।’
সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী বলেন, ‘পলিটিকাল পার্টির পলিটিকাল ইকোনমি কোথায়। আপনাদের একজন কর্মী কিভাবে জীবনযাপন করবে, সেটি খোঁজ নেন না কেন। মনোনয়ন যদি চার কোটি হয়, সেই বিজয়ী হয়ে মানুষের তার বেশি কয়েকগুণ কামাবে। তাহলে কি হলো?’
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আমাদের কোনো জাতীয় নিরাপত্তা পলিসি নেই। এটি গঠনে সচেতনতা, ডায়লগের বিকল্প নেই। এটা দরকার ছিল পলিটিক্যালি দলগুলোর করার কথা এই পলিসি নিয়ে ডায়লগ করা, কিন্তু কোন রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ করেনি। অনুরোধ করব, রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে ওপরে কথা বলতে হবে, ফন্ট লাইনে আনতে হবে।’
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এসআইজিপি (SIGP)-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো প্রফেসর এম এ রশীদ বলেন, ‘৫৪ বছরে এ দেশে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা বা নীতিমালা হয়নি। কি অবাক? যুদ্ধের সময় ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশে কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না, অথচ তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী সদস্যরা। আওয়ামী লীগ নেতারা সেই চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছেন। মূলত, ভারত ভাবতো বাংলাদেশকে তাদের একটি কলোনি হিসেবে। ভারতের প্রোপাগান্ডা এখনো থামেনি, এদেশে তাদের দোসররা এখনো ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জবান-এর সম্পাদক রেজাউল করিম রনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ দিন ধরে বলে আসছি, সামরিক বাহিনীকে পুনর্গঠন করা দরকার। কিন্তু সেটি কার্যকর করা হচ্ছে, জানি না। এখন এসেছে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টা। এখন নতুন বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। পৃথিবীতে রাষ্ট্র তৈরি হয় শত্রুতা দিয়ে, কিন্তু আমাদেরকে বোঝানো হয়েছে, বন্ধু রাষ্ট্র। আমাদের জিও পলিটিকাল ফাউন্ডেশন পরিবর্তন করতে হবে। মনে করি, জন সার্বভৌমত্ব পক্ষ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা প্রস্তাবনা করা এখন জরুরি।’
ধর্মীয় বিশ্লেষক আবু আহমেদ শরীফ বলেন, ‘৫৪ বছরের কি আমরা এ দেশের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পেরেছি। আগের মতো ধারাবাহিক নিয়মে এগোতে চাই, তবে কোনো কিছুরই সমাধান হবে না। জাতীয় ফিলোসফি না থাকলে কোনো কিছু সম্ভব নয়। তবে এক্ষেত্রে ধর্মীয় দর্শন কাজে লাগাতে হবে। শুধুমাত্র একমাত্র ইসলামে আছে একটি দেশকে পুনর্গঠন ও জাতি নির্মাণ। আমরা ফিল করি, বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ইসলামী দেশ। কিন্তু সেটি আমরা অস্বস্তিবোধ করি। কেন জানি, অদৃশ চাপ এসে যায় অনেকের কাছে। ইসলামকে আলাদা করে রেখে রাষ্ট্রের সমস্যা কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারব না। ৫৪ বছর পরও যদি আমরা নিজেদের ইসলামী রাষ্ট্র মুখে বলতে না পারি, তবে আমরা আগের জায়গায় রয়েছি।’