জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নভেম্বরে গণভোট আয়োজন প্রশ্নে এক সপ্তাহেও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ডাকে সাড়া দেয়নি বিএনপি। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অধিকাংশ দল বসতে রাজি হলেও বিএনপির অনঢ় অবস্থানের কারণে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন অচলাবস্থার মধ্যে ঘুরে ফিরে সরকারের সিদ্ধান্তের দিকেই ফিরে গেল প্রস্তাব।
প্রসঙ্গত, জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যে সময়সীমা দিয়েছিল, তা শেষ হচ্ছে আজ। এই সময় সীমার মধ্যে রাজনীতিবিদরা বসতেই পারলেন না এক টেবিলে। বলতে পারলেন না কথা। নিতে পারলেন না সিদ্ধান্ত। উল্টো বিভাজনের মাত্রাটা বাড়ালেন। রাজপথ উত্তপ্ত হলো। কিন্তু, এই অচলাবস্থা নিরসনের কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না শেষ সময়েও।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, একটা দল বলছে গণভোট হতে হবে নির্বাচনের আগে। আমরা বলছি, গণভোট যদি হতেই হয় নির্বাচনের দিনে হতে পারে। গণভোট, সনদ এগুলো আমরা বুঝি না, জনগণ বোঝে না। কিছু ওপর তলার লোক আমেরিকা ও অন্য জায়গা থেকে এসে এগুলো আমাদের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তবে আমরা বিএনপি থেকে বলেছি, এগুলো আমরা মেনে নিয়েছি। পরিবর্তন আমরা চাই, তবে যে পরিবর্তনগুলোতে আমরা একমত নই সেগুলো নির্বাচিত সংসদে গিয়ে তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এর আগে শনিবার বিএনপির আরেক শীর্ষ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কেবলমাত্র প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পেলেই তারা অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে আলোচনার ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে, অন্য একটি রাজনৈতিক দল কেন এমন আমন্ত্রণ জানাবে ? বিপরীতে এই অচলাবস্থা নিরসনের উপায় খুঁজে বের করতে আলোচনা করছেÑএনসিপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ ও গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল।
এদিকে পাঁচ দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জামায়াতসহ আটটি ইসলামি দল হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তাদের দাবিগুলো পূরণ না হলে ১১ নভেম্বর সমাবেশ করবে এবং সেখানে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করা এবং এ মাসের মধ্যেই গণভোটের আয়োজন করা।
গণভোটের সময়, সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে সরকার গত ৩ নভেম্বর দলগুলোকে আহ্বান জানায় শিগগির একটি অভিন্ন সিদ্ধান্ত জানাতে এবং সম্ভব হলে সেটা যেন সাত দিনের মধ্যে হয়।
ওইদিন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, 'আমরা কোনো আল্টিমেটাম দেইনি, আহ্বান জানিয়েছি। আমরা অপেক্ষা করব, তারপর অবশ্যই সরকার সরকারের মতো কাজ করবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার জন্য গত বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে টেলিফোন করেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। বিষয়টি নিয়ে ওইদিনই স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা করে বিএনপি। বৈঠকে আলোচনায় বলা হয়, কেবল সরকার উদ্যোগ নিলে আলোচনায় বসবে বিএনপি। একই সঙ্গে এমন পরিস্থিতি তৈরির জন্য সরকারের সমালোচনাও করেন দলটির নেতারা। পাশাপাশি আলোচনার জন্য জামায়াতের আহ্বানকে ‘সঠিক পন্থা নয়’ বলেও মত দেয়া হয়।
এ বিষয়ে সরকারের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গতকাল এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের আহ্বান জানান কোনো বিষয়ে আলোচনার জন্য যেকোনো ইস্যুতে, আমরা সব সময় আলোচনায় আগ্রহী। কিন্তু অন্য কোনো একটি রাজনৈতিক দল দিয়ে আমাদের আহ্বান জানানো হচ্ছে কেন ?
আলোচনার প্রসঙ্গে না গিয়ে এক কদম এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এমন সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। এই সরকার নির্বাচিত সরকার নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনাদের এ রকম কোনো এখতিয়ার নাই, আমাদেরকে ডিকটেট (আদেশ) করার যে সাত দিনের ভিতরে আপনারা সিদ্ধান্ত না হলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। এত শক্তি প্রদর্শন আপনাদের বোধ হয় মানায় না।
জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুল্লাহ তাহের বলেন, আলোচনার জন্য টেলিফোন করে সাড়া পাইনি। এখন দেখব সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়। যদি সোমবারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত দিয়ে আদেশ জারি না করা হয়, তবে জামায়াত এবং যুগপৎ আন্দোলনের আট দলের রাজপথে নামা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। পরের দিন থেকেই আন্দোলন হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি গণভোটের সময় নিয়ে নমনীয় হলেও জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট থাকতে পারবে না বলে শর্ত দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। কিন্তু কোনো দলই ছাড় দিতে রাজি হচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সঙ্গে বসার কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত না নিলে অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সে বিষয়ে প্রস্তুতিমূলক অনেক মিটিং হচ্ছে। তবে আমরা আশা করবো পলিটিক্যাল পার্টিগুলো নিজেরা নিজেরাই আলাপ-আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে আসবে। শফিকুল আলম আরও বলেন, আইন উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সপ্তাহের মধ্যে নিজেরা বসে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেছিলেন। আর তা না হলে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।