আজ সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন প্রফেসর ইউনূস

দিন শেষে উপদেষ্টা পরিষদের অনির্ধারিত বৈঠকের খবরে স্বস্তি মিলেছে। মিটিংয়ে আলোচনা এবং কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে বিশৃঙ্খলাকারীদের। বলা হয়েছে, সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকা- অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এর আগে দিনভর প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ ও এর আনুষঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের মুখে মুখে। সরব ছিলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে নানা ইস্যু।

শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে জানানো হয় বৈঠকে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের উপর অর্পিত তিনটি প্রধান দায়িত্ব (নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার) বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাজধানীর শের-ই-বাংলা নগর এলাকায় পরিকল্পনা কমিশনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বিবৃতিতে বলা হয় দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অযৌক্তিক দাবি দাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও এখতিয়ার বহির্ভূত বক্তব্য এবং কর্মসূচি দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে তোলা হচ্ছে এবং জনমনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা হচ্ছে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় বৈঠকে।

দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এদেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন বলে মনে করে উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে অন্তর্র্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনবে এবং সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করবে।

শত বাধার মাঝেও গোষ্ঠীস্বার্থকে উপেক্ষা করে অন্তর্র্বর্তী সরকার তার উপর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের উপর আরোপিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হয়, তবে সরকার সকল কারণ জনসমক্ষে উত্থাপন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের জনপ্রত্যাশাকে ধারণ করে। কিন্তু সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকা- অর্পিত দায়িত্ব পালন করাকে অসম্ভব করে তুললে সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

এদিকে একনেকের বৈঠক শেষে গতকাল কথা বলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সেখানে তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা যাচ্ছেন না। তিনি চলে যাবেন বলেননি। তিনি অবশ্যই থাকছেন। আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব বড় দায়িত্ব, এই দায়িত্ব ছেড়ে আমরা যেতে পারবো না। আমরা যে কাজ করছি এবং এসব কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সবাই প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছি। এখন সেগুলো সমাধান করে আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবো।

সারাদিন যা ঘটলো :

গতকাল সকালে মজলিসে শূরার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান জনগণকে স্বস্তি এবং আস্থায় রাখতে সরকারকে সমস্যা সমাধানে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানান। সেইসাথে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।

জামায়াতের আমীর বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন জাতীয় নির্বাচন তিনি এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন করতে চান। এতে আমাদের আস্থা রয়েছে। এব্যাপারে আমরা সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে চাই। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে অবস্থান করছি। এই বাঁক সফলভাবে উত্তরণ করতে হবে। বিশেষ করে গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাসীসহ দেশবাসীকে বিচলিত করেছে। এব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। আমরা দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভা করে দেশের চলমান বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আলোচনায় আমরা বলেছি সংঘাত-সংঘর্ষ এবং কাদা ছোড়াছুড়ি করে জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া একেবারেই সমীচীন হবে না।

এরপরই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি এনসিপি। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা উচিত। বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ একত্রে ঘোষণা করা দরকার। সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটা সুষ্ঠু সমাধানে যাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সবাইকে দায়িত্বশীলভাবে আলোচনা করতে হবে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কথা ভেবে আমাদেরকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ৬২৬ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তালিকা যদি আগেই প্রকাশ করা হতো তাহলে জনমনে শঙ্কা তৈরি হতো না। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারতো না। আমরা দেখেছি সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাজনীতির একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। ওয়ান ইলেভেনের সময় আমরা দেখেছি। এটা সুখকর নয়। বিগত সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। যেসব সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ রয়েছে অনেকেই গ্রেফতার হয়নি, বা কী অবস্থায় আছে আমরা জানি না।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দিকে যাওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশন আস্থার জায়গা হারিয়েছে বলে আমরা মনে করি। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে আস্থাটা তৈরি করতে হবে অথবা দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে বলে আমরা মনে করি।

এদিকে দুপুরের দিকে সাংবাদিক সম্মেলন করে খেলাফত মজলিস বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের সুযোগ নেই জানিয়ে সর্বদলীয় জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করে খেলাফত মজলিস। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশবাসী সকলের মধ্যে আশঙ্কা বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ বা অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে অন্যদের মতপার্থক্যের বিষয়ে যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে জনগণ খুবই উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান ঘটেছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে মতবিরোধ, মতভেদ প্রকাশ্য রূপ নেয়। ইতিমধ্যে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে মতপার্থক্যের খবর প্রকাশ পায়, যা কোনভাবেই কাম্য নয়। ‘এ পরিস্থিতিতে খেলাফত মজলিস মনে করে, আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দেশের চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমন করা সম্ভব।

অন্যদিকে গত রাতেই বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি বৈঠক করে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায়নি বিএনপি। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ চায় বিএনপি। সেইসাথে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন তারা। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহ উদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতের আমীরের সঙ্গে ছিলেন দলের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

এদিকে আজ রোববার সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। বিকেলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন নবেল বিজয়ী ইউনূস। সব দলের সাথে আলোচনা করে একটি সন্তোষজনক সমাধান আসার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেছেন, কিছু মানুষের গাদ্দারির জন্য জুলাইয়ের ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। ঐক্য ধরে রাখার জন্য আমরা সবগুলো ছাত্রসংগঠনের সাথে আলোচনায় বসবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই ঐক্য নষ্ট হয়েছে কিছু মানুষের গাদ্দারি ও বিশ্বাসঘাতকতা ও জুলাইকে কুক্ষিগত করে নিজেদের মতো করে ফ্রেম করার কারণে।

শনিবার বিকেলে ঢাবির সূর্যসেন হল ক্যাফেটেরিয়ার সামনে শিক্ষার্থীদের জন্য ঠান্ডা পানির মেশিন স্থাপন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।

জাতীয় সরকার দাবি ইনকিলাব মঞ্চের :

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদি বলেন, আমরা আবারও জাতীয় সরকারের দাবি করছি; যেখানে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার করতে হবে। জাতীয় ঐক্য বিনির্মাণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ সব কথা বলেন। এ সময় ইনকিলাব মঞ্চের অন্য নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

মার্চ ফর ইউনূস :

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করার দাবিতে শাহবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘মার্চ ফর ইউনূস’ কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচির আয়োজন করা হয় ‘দেশের সর্বস্তরের জনগণ’ ব্যানারে। আয়োজকরা জানিয়েছেন, ড. ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করার পাশাপাশি জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই কর্মসূচি শুরু হয়। কর্মসূচিতে তারা আরও তিনটি দাবি জানায়। সেগুলো হলো- সংবিধান সংস্কার, ‘জুলাই গণহত্যাকারী’ আওয়ামী লীগের বিচার সম্পন্ন এবং ড. ইউনূসকে পাঁচ বছর সময় দেওয়া।

রেমিট্যান্স শাট ডাউনের হুঁশিয়ারি :

চলমান পরিস্থিতিতে যদি ড. ইউনূস পদত্যাগ করেন তাহলে আবারও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীরা। তারা বলছেন দেশের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংস্কার কাজে ড. ইউনূসের কোনো বিকল্প নেই। ড. ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন তাহলে প্রবাসীরা আবারও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বিভিন্ন গ্রুপে রেমিট্যান্স শাটডাউনের হুঁশিয়ারি দিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন চালাচ্ছেন তারা।