দেশের মানুষের জন্য জনমুখী, সহজলভ্য এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন। তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়ার সুপারিশ করেছেন বলে জানান কমিশনের সদস্যরা। গতকাল সোমবার সকালে হেয়ার রোডের বাসভবনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সুপারিশগুলো জমা দেয় সংস্কার কমিশন। এ সময় কমিশন প্রধান অধ্যাপক এ কে আজাদ খান ও তার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এসময় প্রধান উপদেষ্টা দেশের স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘ দিন থেকে যেসব সমস্যা রয়েছে তা নিরসনে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য তা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশ দেন।
স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের এই প্রতিবেদনকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো বহুদিনের সমস্যা, এর মাধ্যমে আমরা যদি এসব সমস্যার সমাধান করতে পারি তা হবে যুগান্তকারী ঘটনা। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সুপারিশ আশু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এখনি মনোযোগী হতে হবে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ডাক্তারের সংকট, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তার থাকলেও যেখানে দরকার সেখানে ডাক্তার নেই। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে। চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ছাড়া সমস্যা নিরসন সম্ভব নয়। চিকিৎসকদের যেখানে পোস্টিং সেখানে থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। কমিশন প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এই কমিশনের সদস্যরা তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার নিকট হস্তান্তর করেন।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ইনফরমেটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক লিয়াকত আলী, ডা. সায়েবা আক্তার, সাবেক সচিব এম এম রেজা, ডা. আজহারুল ইসলাম, ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি উমায়ের আফিফ। স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের অন্য দুই সদস্য হলেন ডা: নায়লা জামান খান, ডা: মোজাহেরুল হক।
এদিকে স্বাস্থ্য খাতের সুপরিশ নিয়ে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সামনে আসেন সংস্কার কমিশন। তারা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদে অর্ডিন্যান্স আকারে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে এবং সংবিধান সংশোধনপূর্বক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে প্রদান করতে হবে।
এক্ষেত্রে রোগী সুরক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ ও ধারাবাহিকতা, জবাবদিহিতা ও জরুরি ভিত্তিতে প্রস্তুতি নিশ্চিত করার জন্য সকল সংশ্লিষ্ট পুরাতন আইন পর্যালোচনা ও যুগোপযোগী করতে হবে এবং নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। প্রস্তাবিত আইনগুলো হলো- বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন আইন, বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস আইন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা আইন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ ও প্রবেশাধিকার আইন, অ্যালায়েড হেলথ প্রফেসনাল কাউন্সিল আইন এবং বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল আইন।
সুপারিশে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন গঠনের তাগিদ দিয়ে কমিশনের সুপারিশে বলা হয় সকল নীতিতে স্বাস্থ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও স্থায়ী বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করতে হবে; যা সরকার প্রধানের নিকট জবাবদিহি করবে এবং সংসদে বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে। কমিশন ১৭টি বিভাগের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠনের তাগিদ দিয়ে কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়- সার্বজনীন ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাতের সাথে এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে সেবার ব্যবস্থাপনা করতে হবে। পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ক্যাডার পুনর্গঠনের মাধ্যমে প্রশাসনিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস গঠন করতে হবে। বিদ্যমান স্বাস্থ্য ও সংশ্লিষ্ট ক্যাডারগুলোেেক পুনর্গঠনপূর্বক একটি পেশাভিত্তিক, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পৃথক ও স্বাধীন প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে হবে; যার নেতৃত্বে থাকবে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় ও একজন মুখ্য সচিব মর্যাদাসম্পন্ন চিকিৎসক। বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসের অধীনে তিনটি খাত- ক্লিনিক্যাল সেবা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা পরিচালনা করবেন উপ-প্রধান ও মহাপরিচালকগণ।
বিভাগীয় পর্যায়ে ১১টি আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ থাকবে এবং বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীকরণ, বাজেট ও পরিকল্পনায় আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা প্রদান করে কার্যকর, স্থানীয় চাহিদাভিত্তিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসেস প্রস্তাবিত রূপান্তর প্রক্রিয়ায় বলা হয়, পরিবার পরিকল্পনা, স্থাস্থ্য অর্থনীতি, নার্সি, তামাক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং যানবাহন ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে একীভূত করা হবে। এসব সংস্থার সেবা প্রস্তাবিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসেস এর সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসমুহের সাথে উপযুক্তভাবে একীভূত করা হবে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস স্বাস্থ্য ক্যাডারকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসিত ক্যাডারে রূপান্তর; এই ক্যাডারটি বিচারিক ক্যাডারের ন্যয় একটি স্বাধীন সিভিল সার্ভিস ক্যাডার হবে এবং এর নাম হবে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস। প্রত্যেক কর্মকর্তাকে বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
গ্রামে ও শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করে বলা হয় - গ্রামে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ও পরিবার কল্যাণকেন্দ্র একত্র করে এবং শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক কেন্দ্র গড়ে প্রথম স্তরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রেফারেল ব্যবস্থা কাঠামোবদ্ধ ও প্রযোজ্যক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক রেফারেল ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে রোগী সঠিক সময়ে সঠিক স্তরের সেবা পায় এবং উচ্চতর প্রতিষ্ঠানে ভিড় কমে।
জনবল সংস্কারে বলা হয় প্রস্তাবিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস কাঠামোতে স্বাস্থ্য সমস্যার আলোকে চাহিদা নিরূপণ করে জরুরী ভিত্তিতে জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর থাকতে হবে একটি কার্যকর পরিকল্পনা। যা স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ কর্মী নিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রদান করবে।
স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়ন প্রসঙ্গে বলা হয়, সরকারকে প্রাথমিক স্বাস্ত্যসেবাকে বাজেট কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিবছর স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। বলা হয় স্বাস্থ্য্যখাতে টেকসই, ন্যায্য ও পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অর্থায়ন সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে স্বাস্থ্যকে জনকল্যাণমূলক ও মেধাভিত্তিক খাত হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় নিরাপত্তা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়নের কৌশলগত খাত হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বিপর্যয়কর চিকিৎসা ব্যয় কমাতে লক্ষভিত্তিক চালু করতে হবে।
স্বাস্থ্য গবেষণার বাজেট বৃদ্ধির সুপারিশ করে বলা হয়- জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য গবেষণার জন্য কমপক্ষে এক শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে তা ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। গবেষণা অনুদান ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ আইনগত কাঠামোর অধীনে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল এর অবকাঠামোগত, আর্থিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়।
জেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত চিকিৎসা সহজলভ্য ও সেবার বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করে বলা হয় জাতীয় ইনস্টিটিউটগুলোর ওপর রোগীর চাপ হ্রাস করতে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ধাপে ধাপে সেকেন্ডারি ও বিশেষায়িত স্বাস্থসেবা চালু করার কথা বলা হয়। সেইসাথে প্রতিটি বিভাগে আন্তর্জাতিক মানের একটি আঞ্চলিক রেফারেল হাসপাতাল গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্লিনিক্যাল সেবাকে জনস্বাস্থ্য সেবা থেকে পৃথক করতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতার অভিযোগ নিস্পত্তির ব্যাপারে বলা হয়, পেশাগত অবহেলার অভিযোগে সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলের অনুমতি ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। তদন্ত ও সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সহিংসতা রোধে মেডিকেল পুলিশ নামে প্রশিক্ষিত একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করতে হবে যা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কাগজবিহীন ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য ইউনিক স্বাস্থ্য আইডিকার্ড স্মার্ট স্বাস্থ্যকার্ড চালুর সুপারিশ করা হয়। সেবার ধারাবাহিকতা ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড রাখার জন্যই এই সিস্টেম চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য সেক্টরে ক্রয় আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিটি মহাপরিচালকের দপ্তরে একটি দুর্নীতি প্রতিরোধ টিম থাকবে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশনের অধীনে ইন্টার্ন চিকিৎসক, পোস্ট গ্যাজুয়েট ছাত্র-ছাত্রীদের ভাতা, বেতন কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। বিদেশে চিকিৎসা নির্ভরতা কমানোর জন্য বাংলাদেশকে আঞ্চলিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে বলা হয়, মেডিকেল ট্যুরিজম সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে।