ইবরাহীম খলিল : সম্ভবত এটাই প্রথম। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে জাতিসংঘে অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন। এর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির ৬ জন শীর্ষ নেতা রয়েছেন। ফ্যাসিবাদ পলায়নের পর জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে রাজনীতিবিদদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে বেশ কিছু সমস্যা বিদ্যমান, তার জট খুলতেই এই পদক্ষেপ। রয়েছে আরও কিছু হিসাব নিকাশ। সবকিছু মিলিয়ে বেশ কিছুদিন সরকারের দৃষ্টি থাকবে জাতিসংঘের দিকে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের বাইরেও এবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুর সম্মেলনটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশে ও বিদেশে সবাই বাংলাদেশের রাজনীতির আগামীর গতিপ্রকৃতি বোঝার লক্ষ্যে রাজনীতিকদের মুখোমুখি হবেন। আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো বাংলাদেশে স্থিতিশীল, নির্বাচিত, দীর্ঘমেয়াদি সরকারের অপেক্ষায় আছে। ফলে আগামী নির্বাচন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনের ফলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধনে ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন বিভিন্ন ইস্যুতে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা শুরু করে। এসব আলোচনা পরিচালনা করেন ড. আলী রীয়াজ। যিনি ঐকমত্য কমিশনে সহসভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এবারের সফরে ড. আলী রীয়াজও যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়াতে এক ধরনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, ঐকমত্য কমিশনে থেকে যাওয়া সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
রোববার রাতে প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে রওয়ানা হন। তার সফরে রাজনীতিবিদদের মধ্যে সফরসঙ্গীরা হলেন- বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। এছাড়া জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ড. নকিবুর রহমান তারেক, যিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকেই প্রতিনিধিদলে যোগ দেবেন।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে দেশ চালানোর দায়িত্ব যেহেতু রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকবে, তাই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও সফরে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ড. ইউনূসের এমন সফরকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অনেকেই বলছেন, বিশ্বকে ঐক্য দেখাতেই প্রধান উপদেষ্টা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, আগে ক্ষমতাসীন দল বিদেশ সফরে গেলে নিজেদের দল বা জোটের কয়েকজন প্রতিনিধিকে সঙ্গে নিত। কিন্তু এখন তো কোনো দল ক্ষমতায় নেই। তাই এবার কিছু নির্দিষ্ট দল থেকে প্রতিনিধি নেওয়াকে অনেকে বিশেষ কৌশল মনে করছেন। কেউ বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে এখনো সমঝোতা হয়নি, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমানোর উদ্যোগ হিসেবেও এটি হতে পারে। আবার কেউ মনে করছেন, বিশ্বকে দেখানোর জন্য যে দেশে জাতীয় ঐক্য আছে, সরকার সেই বার্তাও দিতে চাচ্ছে।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে শীর্ষ নেতাদের এই সফর নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেছেন, এবারের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় আসবে, যার জন্য ধারাবাহিকতা জরুরি। সম্প্রতি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে হওয়া সেমিনারেও দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের যুক্ত করা হয়েছিল। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে তাদের সম্পৃক্ত রাখতে চায় সরকার।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ড. ইউনূসের সফরের মাধ্যমে একটি নতুন ধরণের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সংমিশ্রণ তৈরি হতে পারে। যেহেতু জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদান একদিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়, অন্যদিকে এটি দেশে রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে নতুন রং দেয়। ড. ইউনূসের সফর, রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি, জাতিসংঘে যোগদান এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, রাজনৈতিক ঐক্য সবার সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মার্কিন প্রভাবের যে বিষয়টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেখানেও রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে রাখতে চাইছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এছাড়া তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের সমাধানের পথ খুলতে পারে বলেও মনে করেন মি. আহমেদ। তিনি বলছেন, ‘জাতিসংঘের মূল বৈঠকের সাইডলাইনে আরও অনেক কিছুই হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বিবিসি বাংলাকে বলেন, সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পাশাপাশি কিছু সেশন আছে যেখানে আমাদের পার্টিসিপেশন আছে। এছাড়া বাংলাদেশ কমিউনিটির সঙ্গেও একটা মিটিং আছে। রাজনৈতিক নেতাদের এই সফরে যুক্ত করার কারণ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কিছু ধারণাও দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেছিলেন, যেহেতু আমরা একটি রূপান্তর পর্যায়ের দিকে এগোচ্ছি এবং দেশ পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে হস্তান্তর করা হবে, তাই তাদের প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা হওয়ায়, শেষ কয়েক মাসের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সব কাজের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত রাখতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার, যাতে ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা এসব কাজের ধারাবাহিকতার বিষয়ে অবগত থাকে।
এনসিপি নেত্রী ডা. তাসনীম জারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছি। আমাদের দলের পক্ষ থেকে সদস্য সচিব জনাব আখতার হোসেন ও আমি সফরে অংশ নিচ্ছি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চলমান প্রচেষ্টা ও সবার অংশগ্রহণের ইতিবাচক উদাহরণ বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী।