বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের দোসররা নেপালের প্রাধানমন্ত্রীকে প্রণামের একটি ছবি নিয়ে অপ্রচার, বাংলাদেশে ছাত্ররা উপদেষ্টা হয়েছে বলে ক্ষমতালোভী হিসেবে চিত্রিত করা, নেপালে নির্বাচন, পিআরের কারণে নেপাল ধ্বংস হয়েছে, এরকম অপপ্রচার করে জূলাই গণঅভ্যূত্থানকে বিতর্কিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে বলে অভিমত ব্যক্ত করে লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রাজীব আহমদ। শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি এ মন্তব্য করেন।

সংগ্রাম পাঠকদের জন্য তার ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

তিনি লিখেন, “নেপালের প্রাধানমন্ত্রীকে প্রণামের একটি ছবি দিয়ে দাবি করা হচ্ছে, জেন-জিরা অভ্যুত্থানে ক্ষয়ক্ষতি আগুন প্রাণহানীর ক্ষমা চাইছে। তারা ফিরে যাচ্ছে ক্লাসে।

১. এই ভুয়া ও মিথ্যা আলাপটা দিচ্ছে হাসিনার আমলে ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করা লোকগুলো। আলাপের উদ্দেশ্য হল, এটা প্রতিষ্ঠা করা, দেখে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কত ক্ষমতা লোভী।

২. প্রকৃত তথ্য হল, নেপালের জেন-জি ক্ষমা টমা কিছু চায়নি। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির সংস্কৃতি অনুযায়ী নয়া প্রধানমন্ত্রীকে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেছে একজন। বাংলাদেশে এমন একটা ছবি থাকলে, হাসিনা ভক্তরা বলতেন, ইউনূসের পায়ে পড়েছে ছাত্ররা।

৩. নেপালের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন 'হামি নেপাল' বারবারই আগুন-ভাঙচুরের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছেন, সহিংসতা লুটপাট মতলববাজ দুষ্কৃতিকারীদের কাজ। এর সঙ্গে ছাত্রদের সম্পর্ক নেই।

গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের সময়েও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একই কথা বলেছিল। বারবার বলেছেন, সহিংসতাকারীরা ছাত্র নয়। ঠিক একই বক্তব্য দিয়েছে হামি নেপাল।

৪. কিন্তু ফ্যাসিবাদের পক্ষে বয়ান দেওয়া লোকগুলোর তো দরকার জুলাই অভ্যুত্থানকে ডিফেইম করা। তা জেনে বুঝেই মিথ্যা ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশে ছাত্ররা উপদেষ্টা হয়েছে বলে ক্ষমতালোভী হিসেবে চিত্রিত করার অব্যহত চেষ্টা করছে হাসিনা সমর্থকরা। এখন দিচ্ছে নেপালের উদাহরণ। কিন্তু দুষ্টুগুলো জানে না, নেপালে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কিকে নির্বাচিত করেছে। প্রকৃত তথ্য হল, আন্দোলন সাড়ে ১৪ হাজার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিসকোর্ডে ভোট দেওয়া ব্যক্তিদের ৪৯ শতাংশ সুশীলাকে ভোট দিয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন ২৪ বছর বয়সী সাগর ঢাকালও। ছিলেন ৪০ বছর বয়সী হারকা সামপাং।

৫. সুশীলা কার্কির সরকার আগামী ৫ মার্চ নির্বাচন আয়োজন করবে। নেপালে, মাত্র ছয় মাসে নির্বাচন হলে বাংলাদেশে কেনো দেড় বছর? এ প্রশ্নও করা হচ্ছে। এর জবাব হচ্ছে, নেপালে শুধু সরকার নয়, সরকারি দল, বিরোধী দল, সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলসহ সবাইকে পাইকারি হারে পিটিয়েছে ছাত্ররা। কাউকে ছাড়েনি। সকল দলের মানে, সকল দলের এমপি, মুখ্যমন্ত্রী, মন্তীদের ছ্যাচা দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তারপরও নেপালে একটি পলিটিক্যাল স্ট্রাকচার আছে। সেখানে গুম, খুন, ব্যাংক লুট, টাকা পাচার, রাতের ভোট এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়েনি। ফলে নির্বাচন আয়োজন সহজ। বাংলাদেশে কোনো স্ট্রাকচারই অক্ষত ছিল না। এখনও তা ঠিক হয়নি।

৬. বাংলাদেশে অভ্যুত্থান হয়েছে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। গুম, খুন, রাতের ভোট, ব্যাংক লুট, পাচারের বিরুদ্ধে। নেপালে ওরকম কিছু ঘটেনি। তাদের মূল ক্ষোভ ছিল, রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি। আরও ছোট করে বললে, 'নেপো কিডদের' বিরুদ্ধে। মানে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, নেতাদের ছেলে মেয়েরা কোন চাকরি ব্যবসা না করেও বিলাসী জীবন কাটাত। রাজনীতি না করেও, বাপের পরিচয়ে একদিন টুস করে এমপি-মন্ত্রী হয়ে যেত পরিবারতান্ত্রিক দল ও রাজনীতির কারণে। যারা নেপো কিড নামে পরিচিত। তাদের বিলাসিতার ছবি, সামাজিক মাধ্যমে আসার পর, নেপোকিড হ্যাসট্যাগ চলে। তা ঠেকাতে সরকার সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দেয়। অনুমতি নিয়েই এর প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়। দুই ঘণ্টার আন্দোলনে গুলি চলে। একজন শিক্ষার্থীকে আবু সাঈদের মত হত্যা করা হয়। এর ভিডিও দেখে জনগণ ক্ষেপে। সরকারকে বিদায় করে। এখানে বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্য হল, প্রথম দিনেই হত্যার দায় নিয়ে পদত্যাগ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ তিন মন্ত্রী। ১৯ জনের মৃত্যর দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পরেরদিন পদত্যাগ করেন। আর শেখ হাসিনা ১৪০০ মৃত্যুর পরও পদত্যাগে রাজি হননি। তাকে উৎখাত করতে হয়েছে। সুতরাং নেপালের উদাহরণ বাংলাদেশ না।

৭. আরেকটি আলাপ হল পিআরের কারণে নেপাল ধ্বংস হয়েছে। ভুয়া আলাপ। নেপালের ২৭৫ আসনের সংসদের নিম্নকক্ষে ১৬৫ আসন আমাদের মতই পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়। ১১০ আসন আসন পিআর পদ্ধতিতে। দুই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠিত হয়। মানে ১৩৮ লাগে।

ধরুন, পিআর বাদ। তাহলে সরাসরি নির্বাচিত ১৬৫এমপির মধ্যে ৮৩ জন লাগবে সরকার গঠনে। কিন্তু গত তিন নির্বাচনে কোন দলই এককভাবে ৮৩ আসন পায়নি। সেখানেই তৃতীয় দলীয় ব্যবস্থা। আবার আছে ছোট ছোট দল। কোন দল গত ১৫ বছরে এককভাবে ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। জনগণ অঞ্চল ও ধর্ম-জাতে ভাগ হয়ে আছে বলে। ফলে নেপাল কখনও স্থায়ী সরকার পায়নি। বিভক্তির কারণে পিআর না থাকলেও, স্থায়ী সরকার হতো না।

তবে বাংলাদেশেও সংসদের নিম্নকক্ষে পিআর করা উচিত হবে না সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য। উচ্চকক্ষে এটা দরকার, সংবিধানের সুরক্ষার জন্য। সুরক্ষা কীভাবে হবে, তা অতীতে অনেকবার লিখেছি।”