নারী অধিকার আন্দোলনের উদ্যোগে শনিবার (১৭মে) বিকেলে উইমেন্স ভলান্টিয়ার এসোসিয়েশনে ‘নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন : একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেত্রী মমতাজ মান্নানের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করেন নারী অধিকার আন্দোলনের জয়েন্ট সেক্রেটারী এবং ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. শারমিন ইসলাম। তিনি তার প্রবন্ধে নারী কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখিত ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক প্রতিটি পয়েন্ট উল্লেখ করে তার বিপরীতে ইসলামের সঠিক চিত্র তুলে ধরেন ।

সেমিনারে প্রধান আলোচক অধিকার আন্দোলনের উপদেষ্টা এবং ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের প্রফেসর ডা: হাবীবা চৌধুরী বলেন, যে নারী বিষয়ক কমিশন গঠন করা হয়েছে তাদের একটি টক শো দেখে তাদের ব‍্যাপারে আমার যা মনে হয়েছে তা হলো-তারা ধর্ম বিশ্বাস করে না, তারা পুরুষ বিদ্বেষী, পারিবারিক কাঠামো মানেন না। তাই তাদের আসল চরিত্র তুলে ধরতে হবে। তিনি পুরুষদেরকে এই কমিশনের প্রতিবেদনের প্রতিবাদের আহবান জানান।

নারী অধিকার আন্দোলনের সেক্রেটারি ও বাদশাহ ফয়সাল ইনস্টিটিউটের (স্কুল এন্ড কলেজ) সহকারী প্রধান শিক্ষিকা (অবসরপ্রাপ্ত) নাজমুন নাহার বলেন, এই কমিশনের কিছু সুপারিশ ইতিবাচক যা মেনে নিলেও দূ:খজনক ভাবে ইসলামের সাথে অনেকগুলো সাংঘর্ষিক বিষয় উল্লেখ করে সুপারিশ করা হয়েছে আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, যৌন কর্মীদেরকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে দাবী জানানো হয়েছে তা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি প্রশ্ন করেন যারা যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বলেন তারা কি তাদের নিজেদের মেয়ে বা বোনের জন্য এমন পেশাকে মেনে নিবেন?

নারী অধিকার আন্দোলনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (অবসরপ্রাপ্ত) প্রফেসর ডা: নাঈমা মোয়াজ্জেম বলেন, ইসলামিক পারিবারিক আইন অমান্য করার অর্থ হচ্ছে কুরআনকে অস্বীকার করা। উত্তরাধিকারী আইন কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।সুতরাং আমরা মুসলমানরা একে অস্বীকার করতে পারি না, অমান্য বা সংশোধন করতে পারি না।

তিনি আরো বলেন, কমিশন রাষ্ট্রকে ইহজাগতিক প্রতিষ্ঠান মনে করে তাই সংবিধান থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে, আমরা এ সুপারিশের পক্ষে নই। যেহেতু বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ ইসলামের অনুসারী তাই তাদের সংবিধানের শুরুতে ধর্ম প্রাধান্য পাবে এটাই যুক্তিযুক্ত।

ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের লেকচারার ইঞ্জিনিয়ার মারদিয়া মমতাজ বলেন, নারী কমিশনের সুপারিশে বীঙ্গনাদের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও ২৪ শের আন্দোলনের যে নারীরা অংশগ্রহণ করেছে তাদের কথা নেই । তিনি তা অন্তর্ভুক্ত করার জোড় দাবী জানান। তিনি বৈবাহিক ধর্ষনের বিষয়টি নারী নির্যাতন প্রতিরোধের যে আইন রয়েছে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন বলে মনে করেন। অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, নারী কমিশনের উচিত ছিলো হিন্দু পারিবারিক আইনের যে অসঙ্গতি আছে তা উল্লেখ করার। তিনি মনে করেন অভিন্ন পারিবারিক আইন ঐচ্ছিকভাবে গ্রহণের যে সুযোগ রাখা হয়েছে তার মাধ্যমে পারিবারিক কোন্দলের দিকে পরিবারগুলোকে ঠেলে দেওয়া হবে।

নারী অধিকারের জয়েন্ট সেক্রেটারি ডা: তাহেরা বেগম বলেন, মেডিকেল সাইন্সের আলোকে, এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে সমাজে এইচ আইভি সহ অনেক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। তাই তিনি এ প্রতিবেদন বাতিলের দাবি জানান ।

নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেত্রী এবং বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত ডিভিশন চীফ মিসেস মমতাজ মান্নান বলেন, কমিশনের প্রতিবেদনে এমন অনেক সুপারিশ করা হয়েছে যা এদেশের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও কৃষ্টি, আকিদা ও বিশ্বাস, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যেবোধের পরিপন্থি। এগুলো কুরআন ও সুন্নাহরও পরিপন্থি। প্রতিবেদনে অনেক ভাল ও যৌক্তিক সুপারিশমালার সমাহার থাকলেও বৃহত্তর জনাগোষ্ঠীর জীবনবোধের বিপরীতে ইসলাম বিদ্বেষী যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে তাতে কমিশনের প্রতিবেদনটি সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তাই আমরা প্রথমেই এই নারী কমিশনের বিলুপ্তি চাচ্ছি এবং নতুন কমিশন গঠন করে প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের দাবী জানাচ্ছি। এ লক্ষ্যে তিনি নারী অধিকার আন্দোলনের প্রস্তাব সমূহ তুলে ধরেন । প্রস্তাব গুলো হলো-

১ম প্রস্তাবঃ বিদ্যমান কমিশন বিলুপ্ত করে সকল অংশীজনের সমবায়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) কমিশন গঠন করতে হবে।

২য় প্রস্তাবঃ ধর্মকে দায়ী করে নারী ও পুরুষের বৈষম্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ধর্ম বিদ্বেষী মনোভাব পরিহার করে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

৩য় প্রস্তাবঃ পতিতাবৃত্তি সব ধর্মেই নিষিদ্ধ। ইসলামে এটি হারাম। আর নারীর জন্য চরম অবমাননাকার। একে শ্রম-আইনে স্বীকৃতি দেয়া যাবে না। এই সুপারিশ বাতিল করতে হবে।

৪র্থ প্রস্তাবঃ কমিশন সর্বক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমতা বিধানের সুপারিশ করেছে। এটি বাতিল করে ইসলামের ভারসাম্য পূর্ণ যে নীতি-সমতা ও ন্যায্যতা ক্ষেত্রবিশেষ তা বহাল রাখতে হবে।

৫ম প্রস্তাবঃ জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদের (CEDAW) দুটি ধারা (ধারা ২ ও ১৬.১. (গ)) কমিশন প্রত্যাহার করার যে প্রস্তাব সুপারিশ করেছে তা বাতিল করে ধারা দু'টি বহাল রাখতে হবে।

৬ষ্ঠ প্রস্তাবঃ সম্পদ বন্টনে ইসলামের উত্তরাধিকার আইন বলবৎ থাকতে হবে।

৭ম প্রস্তাবঃ কমিশনের অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রর্বতনের সুপারিশ বাতিল করতে হবে।

৮ম প্রস্তাবঃ কমিশন সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরষের সমান অধিকার চায়। কিন্তু তালাকের ক্ষেত্রে একপাক্ষিক ভরনপোষণ চায়। এটি স্ব-বিরোধী, তাই বাতিলযোগ্য।

৯ম প্রস্তাবঃ কমিশন বহুবিবাহ বিলোপ করার প্রস্তাব করেছে। ইসলামে শর্ত সাপেক্ষে এর অনুমতি দিয়েছে। কমিশনের এই প্রস্তাব বাতিল করতে হবে।

বিপুলসংখ্যক নারীদের অংশগ্রহণে বিকেল পাঁচটায় সেমিনার সমাপ্ত হয়।