- ভারতের বিরুদ্ধে চার অভিযোগ
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের মান অনুযায়ী বিচার চলছে। বিচারের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও তিনি (শেখ হাসিনা) উসকানিমূলক এবং অস্থিতিশীল মন্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। ড. ইউনূস আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ন্যায়বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছে।
বুধবার ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি আলেকজান্ডার স্টাব নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকালে দুই নেতা বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, জাতিসংঘ সংস্কার, রোহিঙ্গা সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগদানের প্রচেষ্টা, শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার এবং নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ-প্রাপ্তির প্রচেষ্টাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রফেসর ইউনূস গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাদের অব্যাহত সমর্থনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, গত ১৪ মাসে আমাদের সরকারের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন অপ্রতিরোধ্য। তিনি ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, দেশের ১২ কোটি ৬০ লাখ ভোটারকে শান্তিপূর্ণভাবে এবং উৎসবের পরিবেশে তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের জনগণ গত ১৫ বছর ধরে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন থেকে বঞ্চিত। এখন তারা অধীর আগ্রহে ফেব্রুয়ারির অপেক্ষায় রয়েছে। প্রফেসর ইউনূস প্রেসিডেন্ট স্টাবকে বলেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চলছে। তিনি উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা গভীর রাজনৈতিক সংস্কারের একটি কাঠামো।
রাষ্ট্রপতি স্টাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশনা সম্পর্কেও খোঁজখবর নেন। জবাবে প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে কাজ করছে এবং সক্রিয়ভাবে আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে সার্ক ও আসিয়ানের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে দেখছি। আসিয়ানের সঙ্গে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনারশিপের জন্য আমাদের আবেদন চূড়ান্ত পূর্ণ সদস্যপদের দিকে একটি পদক্ষেপ। ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বিশ্বব্যাপী কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংস্কারের জরুরি প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। প্রেসিডেন্ট স্টাব বলেন, ‘‘বিশ্ব ব্যবস্থা পাল্টে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই জাতিসংঘকে শক্তিশালী করতে হবে। একমত হয়ে প্রফেসর ইউনূস বলেন,বড় ধরনের বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘ অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা বাড়ছে এবং জাতিসংঘ মূলত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অর্থবহভাবে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা হারিয়েছে। দুই নেতা দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকট এবং বর্তমানে বাংলাদেশের আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক তহবিল বৃদ্ধির গুরুত্বের বিষয়টিও তুলে ধরেন।
তারা আঞ্চলিক যোগাযোগ বিশেষ করে স্থলবেষ্টিত নেপাল ও ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশের সুযোগ দিতে বাংলাদেশের কৌশলগত ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন। প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘‘এই উদ্যোগ এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উল্লেখযোগ্যভাবে ত্বরান্বিত করবে। বৈঠকে জ্বালানি উপদেষ্টা ফৌজুল কবির খান ও এসডিজি সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ উপস্থিত ছিলেন।
ভারতের বিরুদ্ধে চার অভিযোগ :
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক বৈঠকে ভারতের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত সার্জিও গোরের সঙ্গে বৈঠকে ভারত সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। সার্জিও গোরকে একমাস আগে ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত বছর গণবিপ্লবকে ভারত ভালোভাবে নেয়নি। এ কারণে দেশটির সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ভারতীয় মিডিয়াগুলোর ভুয়া খবর পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। ভারত থেকে অনেক ভুয়া খবর আসছে। তারা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে। গত বছরের গণবিপ্লবকে তারা ইসলামি আন্দোলন বলেছে।
এছাড়া সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেছেন, ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। তিনিই সমস্যার সৃষ্টি করছে। এগুলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করেছে। সার্ক জোটকে পুনর্জ্জীবিত করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, সার্ক কাজ করছে না কারণ একটি দেশের রাজনীতির সঙ্গে এটি ফিট হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০১৪ সালে সার্কের সম্মেলন হয়। এর পরের সম্মেলনটি ২০১৬ সালে হওয়ার কথা ছিল। তবে উরিতে সন্ত্রাসী হামলার জেরে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করে ভারত। এরপর এ জোটটি বলতে গেলে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
ভারত যদিও এখন সার্কের সদস্য। কিন্তু তারা পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে তৈরি বিমসটেককে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এমনকি ভারত তাদের বিভিন্ন বিষয় বিমসটেকের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানিয়ে থাকে। সর্বশেষ বিমসটেক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠক করেন।
কসোভোর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক
এদিন অধিবেশনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কসোভোর প্রেসিডেন্ট ভিওসা ওসমানি বৈঠক করেন। বুধবার নিউ ইয়র্কের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অভিবাসন, বাণিজ্য এবং পারস্পরিক বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং উভয় দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। অধ্যাপক ইউনূস প্রেসিডেন্ট ওসমানিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং ঢাকায় একটি কসোভো বাণিজ্য প্রতিনিধি দল পাঠানোর আহ্বান জানান, যাতে তারা অর্থনৈতিক সুযোগগুলো অনুসন্ধান করতে পারে। তিনি নিয়মিত যুব বিনিময় কর্মসূচির পক্ষে মত দেন, যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করবে।
প্রেসিডেন্ট ওসমানি কসোভোর প্রতি বাংলাদেশের প্রাথমিক ও ধারাবাহিক সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপীয় দেশটিকে প্রথম স্বীকৃতি প্রদানকারী রাষ্ট্রগুলোর একটি। তিনি কসোভোর সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির কথা তুলে ধরে বলেন, দেশটি টানা দ্বিতীয় বছরের মতো দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। গণহত্যার যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কসোভো সফলভাবে অর্থনীতি পুনর্গঠন করেছে এবং বর্তমানে নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে ইউরোপের অন্যতম নিরাপদ দেশ হিসেবে স্বীকৃত, উল্লেখ করেন প্রেসিডেন্ট ওসমানি।
তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বাংলাদেশি নাগরিক কসোভোতে কাজ করছেন এবং দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে প্রেসিডেন্ট ওসমানি বাংলাদেশ ও কসোভোর মধ্যে কয়েকটি বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেন। বিশেষভাবে তিনি বস্ত্র খাতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সুপারিশ করেন এবং এ খাতে সহযোগিতা ও পারস্পরিক সুফলের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন।
বৈঠকে উপস্থিত আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়োগ বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এ ধরনের একটি চুক্তি নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করবে এবং উভয় দেশের জন্যই সুফল বয়ে আনবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরা কসোভোর আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার প্রশংসা করেন।