তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে ছাত্রজনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নতুন নেতৃত্ব পায় দুর্নীতি বিরোধী রাষ্ট্রীয় একমাত্র সংস্থা-দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে দুদক নড়েচড়ে বসে। নতুন করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দুদক গত ছয় মাসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যসহ ১৩৩ প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। একই সময় ২৪৯ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধান শেষে ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সর্বশেষ গতকাল রোববার চারটি মামলা করা হয়েছে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির হোতা আব্দুল হাই বাচ্চু ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে। দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ ও প্লট জালিয়াতির ঘটনায় শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও তাদের পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে জানুয়ারি মাসে নয়টি মামলা করেছে দুদক। এছাড়া জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, বিদেশে টাকা পাচার, টাকা আত্মসাৎ ও জালজালিয়াতির ঘটনায় শেখ হাসিনার উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১২০টি মামলা করা হয়। এ সময় শেখ হাসিনা ও তার পরিবার, তার শাসনামলের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ ২৪৯ প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধান শেষে ১৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধান ও মামলা ছাড়াও দুদক বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলম, বেক্সিমকোসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করেছে। গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুরসহ পাঁচজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে।

জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন গতকাল রোববার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, শেখ হাসিনাসহ আড়াই শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা-অনুসন্ধান: তথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা করে মোট ২০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে গত ১৪ জানুয়ারি পৃথক দুটি মামলা করেছে দুদক। একই অভিযোগে শেখ রেহানা ও তার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক (রূপন্তী) এবং ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের (ববি) বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করা হয়। এই তিন মামলায় রেহানার আরেক মেয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক এবং রেহানার বোন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামী করা হয়। তিনটি বিমানবন্দরের চার প্রকল্পে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করা হয়।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক হয়েছিলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এই অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এ ছাড়া তার সূচনা ফাউন্ডেশন ও আওয়ামী লীগের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। পাশাপাশি গাজীপুরে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বাগানবাড়ি নিয়েও অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, গত ১৫ বছরে বড় প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। এসব দুর্নীতিতে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম এসেছে।

মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা: দুদক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দুদক প্রথম মামলা করে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। ঘুস গ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ৯ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সর্বশেষ বুধবার সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এর আগে ২ ফেব্রুয়ারি সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে ১১ কোটি ৩৬ লাখ ৫১ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়।

জ্ঞাত আয় বহির্ভূত প্রায় ৯ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ৩ জানুয়ারি সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও তার স্ত্রী মোছা. হোসনে আরা বেগম এবং তাদের ছেলে মো. রাকিবুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ছাড়াও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ একাধিক আমলা ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

সর্বশেষ মামল : ২৪৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ৪ মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রোববার দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মামলায় অবৈধ সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি ৫৮ কোটি টাকা কানাডায় পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। চার মামলার মধ্যে তিনটি মামলাতেই বাচ্চুকে সহযোগী আসামী করা হয়েছে।