হামিদুর রহমান আযাদ
বঙ্গোপসাগরের ফানেল আকৃতির অবস্থানের কারণে এমনিতেই এ অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবন এলাকা। জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম তাঁর সিন্ধু কবিতায় বলেছেন:
"হে ক্ষুধিত বন্ধু মোর, তৃষিত জলধি,
এত জল বুকে তব, তবু নাহি তৃষার অবধি।
এত নদী উপনদী তব পদে করে আত্মদান,
বুভুক্ষু! তবু কি তব ভরিল না প্রাণ?
দুরন্ত গো, মহাবাহু,
ওগো রাহু,
তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ-এক ভাগ বাকি !
সুরা নাই-পাত্র- হাতে কাঁপিতেছে সাকি।
তাই জাতীয় কবির সেই ক্ষুধিত বন্ধু সে তৃষিত জলধি, যার চিত্ত শত ক্ষুধার উদ্রেক করে উপকূলবাসীর জীবন তছনছ করতে তার আনন্দ যেন বেশি। বলা নেই, কওয়া নেই প্রায় সময় সে উত্তাল থাকে। তার মনপবনের ঠিকানা বাংলাদেশের আবহাওয়া দপ্তরও ঠাঁই পায় না। তার প্রায়শ পাগলামি সুন্দরবন বরাবরই মাথা পেতে নিয়ে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা ও পটুয়াখালীকে শেল্টার দিলেও পাথরঘাটা, কুয়াকাটা, ভোলা, হাতিয়া সন্ধিপ, মনপুরা, উরকিরচর, সোনাগাজী, মীরসরাই, ছাগলনাইয়্যার অরক্ষিত উপকূল লন্ডভন্ড করে দিয়ে এর ওপর তান্ডব নৃত্য চালায়। আবার কখনও দক্ষিণ পূর্ব দিগন্তে আনোয়ারা, বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকোরিয়া ও কক্সবাজার উপকূল লন্ডভন্ড করে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। এ অরক্ষিত উপকূলকে উপদ্রুত রাখা বা করাতেই যেন তার তৃপ্তি। ১৭৯৭ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের আইলা পর্যন্ত সময়ের শুমার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মোট ৪৭৮ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, আইলা ও নার্গিসেরা বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পরপর, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরে ১৪৯টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে, যা ছিল ঘন ঘন ও মহা প্রলয়ঙ্কারী। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সর্বশেষ সিডর ও আইলার আঘাতে স্বয়ং সুন্দরবনও পর্যুদস্ত হয়েছে। ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের মহাপ্রলয়ংকরী সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস লক্ষ লক্ষ উপকূলবাসীর জীবন কেড়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশের একদশমাংশ এলাকা উপকূলবেষ্টিত। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে গড়ে ১৩৫০ জন মানুষ। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০০ বছরে অন্তত ৬৪ বার মনে রাখার মতো বড় ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হেনেছে। ফলে কুতুবদিয়া-মহেশখালীসহ সমুদ্র উপকূলে জনগণকে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বর্তমান আধুনিক যুগেও সেখানে কাংখিত উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। জনগণ পাচ্ছে না উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, পাচ্ছে না নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা। এখানে নেই পর্যাপ্ত ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নেই কোনো ভালো চিকিৎসার সুযোগ। উপকূল রক্ষার বেড়িবাঁধের বেহাল অবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত সমুদ্রের জোয়ারের পানি ভেতরে প্রবেশ করে প্রতি বছরই জনগনের আর্থসামাজিক কাঠামো লন্ডভন্ড করে দেয়। সাইক্লোনের আগাম সতর্কতায় উপকূলবাসীদেরকে কখনো কখনো সবকিছু গুটিয়ে নতুন আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার নতুনভাবে জীবন যুদ্ধে নামতে হয় তাদেরকে।
অবহেলিত উপকূলের জনগোষ্ঠী চিংড়ি চাষ, লবণ চাষ, পান চাষ, শুটকি প্রক্রিয়াকরণ, সামুদ্রিক মাছ ধরা, নৌকা তৈরি, পর্যটনসহ নানা পেশায় জড়িত। তাদের মধ্যে রয়েছে অধম্য সাহস ও কর্মস্পৃহা। অধিকাংশ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে ও উপকূলে কঠোর পরিশ্রম করে জীবন নির্বাহ করে।
অথচ তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে মানবসম্পদের উন্নয়ন এবং বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে।
এদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি দেশের উৎপাদন ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। মহেশখালীতে নির্মাণ হচ্ছে গভীর সমুদ্র বন্দর ও বৃহত্তর কন্টেইনার টার্মিনাল। মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল থেকে সারা দেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামের শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। পর্যটন খাতের সিংহভাগ অবদান কক্সবাজার জেলা থেকে আসে। কক্সবাজার জেলা ও বাশখালী উপজেলার লবন উৎপাদন বাংলাদেশে শতভাগ লবন চাহিদা পূর্ণ করে। চিংড়ির মোট জাতীয় উৎপাদনের সিংহভাগ কক্সবাজার জেলায় উৎপাদন হয়। ব্লু ইকোনোমি কক্সবাজার এলাকায় অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এতদ্বসত্বেও কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ উপকূল বেড়িবাঁধ বিহীন, অরক্ষিত ও অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে কুতুবদিয়া উপজেলার চারপাশে ভাঙ্গনপ্রবন এলাকায় টেকসই বেড়্রিবাধ কখনোই নির্মাণ হয়নি। ফলে
কুতুবদিয়া দ্বীপের আয়তন গত ৬০ বছরে ৫০% কমে ১২৫ বর্গকিলোমিটার থেকে ৬২ বর্গকিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। মহেশখালীর ধলঘাটা ও মাতারবাড়িতে ১৯৯১ সালের ভয়াভহ ঘূর্ণিঝড়ের পর একাধিক ওয়ার্ড সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে। বর্ষা শুরুর পূর্বেই লোকালয়ে ও ফসলের মাঠে জোয়ারের পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
অধিকন্তু কুতুবদিয়া সহ কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে্র প্রভাব মোকাবেলার যথাযথ প্রস্ততির বিশেষ করে পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের অভাব রয়েছে। কক্সবাজার উপকূলের জনগন সমুদ্রতীর ভাঙ্গন ও ঘূর্ণিঝড়ের বাস্তব ঝুকিতে রয়েছে। ফলে ২৯ই এপ্রিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় শক্তিশালী কোন ঘূর্ণিঝড় হলে উপকূলীয় উপজেলাসমূহে বিশেষ করে কুতুবদিয়া ও মহেশখালীতে জনজীবন ও জীবীকার উপর বিপর্যয় নেমে আসবে। আসন্ন বর্ষা শুরুর পূর্বে অবিলম্বে বেড়িবাধ মেরামত ও টেকসই বেড়িবাধ নির্মাণের উদ্যেগ নেওয়ার জন্য আমি পানি সম্পদ মন্ত্রাণালয়ের উপদেষ্টার কাছে ডিও লেটার দিয়ে জোর দাবী জানিয়েছি। উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে উপকূলের জনগন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আসন্ন বর্ষা শুরু হওয়ার পূর্বেই বেড়িবাধ মেরামত, পাশাপাশি অনতিবিলম্বে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রত্যাশা করেন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য সামুদ্রিক দুর্যোগে প্রাণ হারানো সকল বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য