যুক্তরাষ্ট্রে সফরের দ্বিতীয় দিনে বিশ্বনেতাদের সাথে দেখা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূস। সেইসাথে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীজনদের সাথে কথা বলেন। এসময় তাদের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন। প্রফেসর ইউনূস সামাজিক ব্যবসা নিয়ে কথা বলেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে নিউইয়র্ক সফররত প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা। মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন, দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর, রাজস্ব ও ব্যাংক খাত সংস্কার, চট্টগ্রাম বন্দর পুনরুজ্জীবন, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতি এবং সমগ্র এশিয়াজুড়ে তরুণদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিলিয়ন ডলারের সম্পদ পুনরুদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করেন তারা। অজয় বাঙ্গা, গত ১৪ মাসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অধ্যাপক ইউনূসকে প্রশংসা করেন। এ সময়টাকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটময় সময়গুলোর একটি উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইউনূস এবং তিনি বিশ্বব্যাংকের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ থেকে চুরি হওয়া তহবিল পুনরুদ্ধারে এবং চট্টগ্রাম বন্দর সংস্কার ও আধুনিকায়নে সহায়তা করতে বিশ্বব্যাংককে আহ্বান জানান। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আধুনিকায়িত বন্দর লাখো উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে পারে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর হলো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাবিকাঠি। আসুন একসঙ্গে উন্নয়ন করি। নেপাল ও ভুটানসহ ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য একটি আধুনিক বন্দর থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হবে। অজয় বাঙ্গা ব্যাংকিং ও রাজস্ব খাতে দৃঢ় সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এগুলো টেকসই ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির ভিত্তি গঠনের জন্য অপরিহার্য।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নিউইয়র্কে মঙ্গলবার প্যারিসের মেয়র অ্যানে হিদালগো বৈঠক করেছেন। বৈঠকে উভয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ক্রীড়া, সামাজিক উদ্যোগ এবং বিশ্বমানবিক সংকট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। সাক্ষাৎকালে দুই নেতা বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে চলমান সংস্কার কার্যক্রম, ক্রীড়া ও অলিম্পিকে সামাজিক ব্যবসার সম্ভাবনা এবং বৈশ্বিক শরণার্থী সঙ্কটÑবিশেষ করে রোহিঙ্গা মানবিক সংকট সম্পর্কে ব্যাপক মত বিনিময় করেন।

এ সময়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী সাধারণ নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। এটি শুধু একটি নির্বাচন নয়, এটি দেশের গণতন্ত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যত নির্ধারণে একটি ভিত্তিমূলক ঘটনা হবে, যা দেশের গণতন্ত্রকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নেবে। অধ্যাপক ইউনূস প্যারিস ২০২৪ অলিম্পিককে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ রূপান্তর করতে নেতৃত্ব দেন। প্রধান উপদেষ্টা ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত সকল অলিম্পিকÑবিশেষত আসন্ন লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকÑকার্বন নিরপেক্ষ করার ওপর জোর দেন।

মেয়র হিদালগো এই সংকটময় সময়ে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি আপনার নেতৃত্বকে গভীরভাবে সম্মান করি। আপনি অসাধারণ কাজ করেছেন, এবং আপনার অঙ্গীকার মানবতার জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উভয় নেতা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তহবিল বৃদ্ধির জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত এক মিলিয়নের বেশি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের আহ্বান জানান। মেয়র হিদালগো আশা প্রকাশ করেন যে একদিন রোহিঙ্গারা নিরাপদ ও মর্যাদাসহ তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবেন।

অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন, ‘জাতিসংঘ আগামী সপ্তাহে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করছে, যার উদ্দেশ্য হলো বৈশ্বিক মনোযোগ পুনরুজ্জীবিত করা এবং এর একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজা। তিনি মেয়র হিদালগোকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের জন্য আন্তরিক আমন্ত্রণ জানান, যা দুই দেশের মধ্যে মানবিক ও সামাজিক ব্যবসায়িক সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করবে। বৈঠকে এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত সামাজিক উদ্ভাবন বিষয়ক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ‘সামাজিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যকর করা।’ এতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সামাজিক উদ্ভাবন ও অর্থায়নের নতুন পথ ও সুযোগ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা ধারণা বিনিময় ও সহযোগিতার ওপর জোর দেন।

এদিন ১৩তম ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট এর অফিসিয়েল ফাস্ট লেডি লাঞ্চনের সাথে প্রফেসর ইউনূস দেখা করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থেনিও গুতেরেসের রিসিপশন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এর আয়োজক ছিলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই অনুষ্ঠানে আমেরিকান ফরেন মিনিস্টার মার্কো রোবিও, জাপান ও ভূটানের প্রধানমন্ত্রী, স্পেনের কিং ফিলিপের সাথে দেখা করেন।