দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কারণে আতঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই; বরং প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গত শুক্রবার ও শনিবার কয়েক দফায় ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় বিশেষজ্ঞরা এ মতামত দেন।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষজ্ঞদের আহ্বান জানান, তারা যেন স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সরকারের করণীয় সম্পর্কে লিখিত পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আমরা হাত গুটিয়ে রাখতে চাই না, আবার অবৈজ্ঞানিক কোনো পদক্ষেপও নিতে চাই না। আপনাদের পরামর্শগুলো দ্রুত লিখিত আকারে আমাদের দিন; সরকার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত। তিনি জানান, প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং এক বা একাধিক টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে কাজ চলছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পাওয়া মাত্রই সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

বৈঠকে উপদেষ্টাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, দুর্যোগ ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রফেসর মো. জয়নুল আবেদীন; বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী; বুয়েটের অধ্যাপক তাহমীদ মালিক আল-হুসাইনী; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আখতার; বুয়েটের অধ্যাপক ড. তানভীর মনজুর; বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. মমিনুল ইসলাম; আবহাওয়াবিদ মো. রুবাইয়্যাত কবীর; ভূতত্ত্ববিদ ড. রেশাদ মো. ইকরাম আলী; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. শাখাওয়াত হোসাইন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণতা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান খান এবং বুয়েটের অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কয়দিন আগে ভয়াবহ ভূমিকম্পে যাদের মৃত্যু হলো, যারা আহত হলেনÑএটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। এমনটি যেন আর না হয়, তার জন্য আমাদের অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, “আপনারা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, অভিজ্ঞতা ভাগ করেছেন। এই আতঙ্ক থেকে জনগণকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা প্রয়োজন, সরকারকে তা জানান। কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে, কোন কোন বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবেÑসব জানান। দুর্ঘটনা যেভাবেই আসুক, যেন আমরা যেন সকল পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পারি। তিনি জানান, ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে কী ধরনের মহড়া প্রয়োজন হবে, সে বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রয়োজন। তিনি বলেন, পাশাপাশি ভূমিকম্পের প্রস্তুতি নিয়ে আমরা কোন পর্যায়ে আছি সেটিও মূল্যায়ন করতে হবে।

বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ও ভূমিকম্প-বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও সমন্বয়ের পরামর্শ দেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আরও বলেন, ভূমিকম্প নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদেরকে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, “আমরা প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য ‘শুভেচ্ছা’ নামে একটি অ্যাপ করেছি। এই অ্যাপের মাধ্যমে বিদেশে থাকা বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের সাথে যুক্ত হোন। অ্যাপটিতে আরও কী ধরনের ফিচার আনা যেতে পারে, সে বিষয়েও আমাদের পরামর্শ দিন।” বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভূমিকম্পকে ঘিরে বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক গুজব তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছেÑ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে... ১০ দিনের মধ্যে... ১ মাসের মধ্যে... বড় মাত্রার ভূমিকম্প হবেÑএ ধরনের অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। তারা বলেন, ভূমিকম্প কখন হবেÑকেউ বলতে পারে না। কোন অঞ্চলে কত বছরে কতগুলো ভূমিকম্প হয়েছে এবং তাদের মাত্রা কী ছিল, তা দেখে একটি সময়সীমা অনুমান করা যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট দিন-তারিখ-সময় বলা যায় না।

বৈঠকে অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান বলেন, ভূমিকম্পের উৎস ও উৎপত্তিস্থল নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখতে হবেÑবাংলাদেশ ও এর আশেপাশে কতগুলো সোর্স আছে এবং সেগুলোর কারণে শেকিং লেভেল কী হতে পারে তা নিরূপণ করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনা কম, কারণ আমরা স্বল্প ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। তবে আমাদেরকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আখতার বলেন, জনসচেতনতা তৈরিতে তরুণদের কাজে লাগানো জরুরি। “ইনডোরে, আউটডোরে, ব্যক্তি পর্যায়ে ও প্রতিষ্ঠানেÑচার স্তরে করণীয় পরিকল্পনা তৈরি করে সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। তরুণদের কাজে লাগিয়ে ন্যাচারাল হ্যাজার্ড প্ল্যান ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নিলে সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবে।”

চুয়েটের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “মন্ত্রণালয় তাদের আওতাধীন স্থাপনাগুলোর মূল্যায়ন করতে পারে। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগÑএসব খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্পবিষয়ক প্রোগ্রাম চালু করলে আতঙ্ক নয়, বরং সচেতনতা তৈরি হবে।”

এমআইএসটি’র অধ্যাপক মো. জয়নুল আবেদীন বলেন, “সবাইকে বোঝাতে হবে যে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আমাদের সম্পদের মধ্যে থেকেই কাজ করতে হবে। করণীয় সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। মানুষকে মাথা ঠান্ডা রাখার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। কোন এলাকায় খোলা জায়গা আছে, কোথায় জমায়েত হওয়া যায়Ñতা জানাতে হবে এবং সে অনুযায়ী মহড়া করতে হবে। বাসাবাড়ি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহড়ার ব্যবস্থা জরুরি।”

বিশেষজ্ঞরা বলেন, হাসপাতালগুলোর কোনো ধরনের ঘাটতি আছে কিনা, ভবনগুলোর মান ঠিক আছে কিনা, জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সক্ষমতা আছে কিনা তা মূল্যয়ন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখতে হবে।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল) মো. খালেকুজ্জামান চৌধুরী জানান, ইতোমধ্যেই একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ভূমিকম্পের ফলে ফাটল ধরা ভবনের ছবি সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এর মধ্য থেকে দুই শটির বেশি ভবনের মূল্যায়ন করা হয়েছে। বেশিরভাগই পার্টিশন দেয়ালে ফাটল দেখা যাচ্ছে। সফটওয়্যারটির মাধ্যমে দ্রুত ফাটল ধরা ভবনের মূল্যায়ন ও পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়েছেÑবিশেষজ্ঞদের পাঠানো লিখিত সুপারিশ নিয়ে সরকার দ্রুত সময়ে আলোচনা করে টাস্কফোর্স গঠন করবে। ভূমিকম্পের বিষয়ে আশু করণীয় নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্সে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা যুক্ত থাকবেন।

সফলভাবে নির্বাচন আয়োজনে কমনওয়েলথের সমর্থন চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা :

এদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন সফলভাবে আয়োজনের জন্য কমনওয়েলথের পূর্ণ সমর্থন চেয়েছেন। গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমনওয়েলথ মহাসচিব শার্লি আয়োরকর বচওয়ের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এ সমর্থন চান।

এ সময়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে আপনারা সমর্থন দেবেন বলে আশা করি। তিনি কমনওয়েলথ মহাসচিবকে বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রতি গভীর আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও উৎসবমুখর পরিবেশে আয়োজনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।

জবাবে কমনওয়েলথ মহাসচিব প্রধান উপদেষ্টাকে আশ্বস্ত করেন, কমনওয়েলথ বাংলাদেশের নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী রূপান্তরের ক্ষেত্রে পূর্ণ সমর্থন দেবে। তিনি বলেন, ‘কমনওয়েলথের ৫৬টি দেশÑযেখানে জি-৭ ও জি-২০-এর সদস্যরাও অন্তর্ভুক্তÑযাদের হাতে বিপুল সম্পদ রয়েছে। এই দেশগুলো একে অপরকে শক্তিশালী করতে সেই সম্পদ ব্যবহার করতে পারে।’

মহাসচিব আরও জানান, তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে প্রধান বিচারপতি, আইন উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি যোগ করেন, ‘দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আমি খুব আশাবাদী।’

মহাসচিব নিশ্চিত করেন, আসন্ন নির্বাচনের আগে পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর জন্য কমনওয়েলথ প্রস্তুতি নিচ্ছে। বৈঠকে দুই নেতা তরুণদের ক্ষমতায়ন, উদ্যোক্তা তৈরি, সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি এবং বেকারত্ব, কার্বন নির্গমন ও বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্য নিয়ে তিন-শূন্য ভিশন বাস্তবায়ন সম্পর্কেও আলোচনা করেন।