ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জরিপ কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেওয়ায় রোগটির বিস্তার রোধে হুমকির মুখে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এক সময় প্রতিবছর তিনটি জরিপ পরিচালনা করলেও, বর্তমান সরকারের মেয়াদে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা তেমন কোনো জরিপ পরিচালনা করেনি। বিগত এক বছরে মাত্র একটি জরিপ করেছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর), যার ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো জরিপ না হওয়ায় জনগণ সতর্ক হওয়ার সুযোগ হারিয়েছে। জরিপের তথ্যের ভিত্তিতে ঝুঁকির মাত্রা বোঝা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়াই রোগ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রণ পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ জানান, প্রাক-মৌসুম, মৌসুমকালীন ও মৌসুম-পরবর্তী জরিপ—এই তিন ধাপে পরিচালিত হলে ডেঙ্গুর বিস্তার ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে একটি রোগতাত্ত্বিক প্যাটার্ন তৈরি হয়। তিনি বলেন, “এই জরিপের ভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে সংক্রমণ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। হঠাৎ করে অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা শুধু ডেঙ্গুই নয়, অন্যান্য সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।”

জরিপ বলছে, ঢাকার একাধিক ওয়ার্ড উচ্চঝুঁকিতে

আইইডিসিআর পরিচালিত প্রাক-মৌসুম জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ছয়টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ২০-এর বেশি, যা উচ্চঝুঁকির সূচক। মধ্যম ঝুঁকিতে রয়েছে আরও সাতটি ওয়ার্ড এবং ১৯টি ওয়ার্ড স্বল্পঝুঁকিপূর্ণ। আটটি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়নি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে সাতটি ওয়ার্ড উচ্চঝুঁকিতে, ১৮টি মধ্যম ঝুঁকিতে ও ১৯টি ওয়ার্ড স্বল্পঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানে ১৫টি ওয়ার্ডে মশার লার্ভার উপস্থিতি মেলেনি।

জরিপে দেখা যায়, সর্বাধিক লার্ভা পাওয়া গেছে বহুতল ভবনে (৫৮.৮৮%), এরপর নির্মাণাধীন ভবনে (১৯.৬৩%), একক বাড়িতে (৯.৮%), সেমিপাকা বাড়িতে (৮.৮৮%) এবং ফাঁকা স্থানে (২.৮%)।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা: মৌসুমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে কঠিন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক জরিপ ও বিশ্লেষণের অভাবে চলতি বছর ডেঙ্গুর গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে জেলা পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে, যার মধ্যে বরিশাল অঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিতে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বরিশালে পানির জমে থাকা পরিস্থিতি সংক্রমণ বাড়াচ্ছে। তবে তিনি বলেন, “সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।”

পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট

গত এক দশকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে রেকর্ডসংখ্যক ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন আক্রান্ত হন, মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। ২০২৪ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪, মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৪৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২৪৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যার মধ্যে বরিশালেই ১৩৮ জন।

বিশেষ ঝুঁকিতে যুবসমাজ

২০২৩ সালের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২১–৩০ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুও এই বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীতেই বেশি। বিশেষ করে ২৬–৩০ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে ৫৬ জনের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পিত জরিপ, দ্রুত তথ্য প্রকাশ এবং স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগ ছাড়া এই রোগের বিস্তার ঠেকানো কঠিন হবে।