# সংবিধান সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয় যাবে গণভোটে # সংবিধানের বাইরের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে # আগামী জাতীয় সংসদের ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হবে # পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে যদি সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে, তাহলে জুলাই সনদে থাকা বিষয়গুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ জমা দিয়ে দ্রুত গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করে কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও এই কমিশনের সভাপতি।
জানা গেছে, ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে অবিলম্বে সরকারি আদেশ জারি এবং এ আদেশের আওতায় একটি গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করেছে। পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ কমিশনের পক্ষ থেকে তাদের সুপারিশগুলো প্রকাশ করে বলেন, এই সুপারিশগুলো কিভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে সেই সুপারিশও তারা সরকারকে দিয়েছেন। সুপারিশ হস্তান্তরের সময় উপদেষ্টা পরিষদের অন্য সদস্যদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড, মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, যেসব বিষয় সাংবিধানিক বিষয় সংশ্লিষ্ট নয়, সরকার যেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারেন, সেটা যেন অবিলম্বে বাস্তবায়িত করা হয়। এর মধ্যে কিছু আছে অফিস অর্ডার দিয়েও বাস্তবায়ন সম্ভব, সেগুলো যেন দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করে।
তিনি বলেন, যেসব সুপারিশ সরকারের কাছে দেয়া হয়েছে সেখানে এগুলো চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে যে, কোনগুলো অধ্যাদেশ বা অফিস অর্ডার দিয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব। সংবিধান সংশ্লিষ্ট মোট ৪৮টি বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে কমিশন এগুলো বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প সরকারের কাছে তুলে ধরেছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আলী রীয়াজ বলেন, আজকের মধ্যেই সব রাজনৈতিক দলগুলোকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সুপারিশমালা পৌঁছে দেয়া হবে। যে সব বিষয় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, সেগুলো সরকারি অধ্যাদেশের মাধ্যমে দ্রুত বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে বাস্তবায়নের জন্য ৪৮টি বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এখানে একসঙ্গে ৪৮টি বিষয় বাস্তবায়নে গণভোট হবে।
সুপারিশ মালায় রয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদের ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হবে। যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন না করে, তাহলে জুলাই সনদে থাকা বিষয়গুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হবে।
জুলাই সনদে স্বাক্ষর নিয়ে তিনি আরও বলেন, যারা স্বাক্ষর করেনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত আছে, এনসিপির সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে, হচ্ছে। এনসিপি স্বাক্ষর করবে বলে আশা করেন তিনি।
প্রশ্ন-উত্তরপর্বে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি জানান, জুলাই সনদের ব্যাপারে সব রাজনৈতিকদলের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন তা বাস্তবায়নে গণভোটের প্রয়োজন। আর এটা সকলেই মনে করেছে যে, জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য এটা অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। সে থেকেই ঐকমত্য কমিশন গণভোটের প্রস্তাব করেছে। তিনি বলেন, গণভোটের তারিখের ক্ষেত্রে ভিন্ন মতের বিষয়টি বিবেচনা করে এবং যেহেতু একটি লজিস্টিকেল আসপেক্ট আছে, ভোটটা কখন করা যাবে, কিভাবে করা যাবে, সেই বিষয়ে যেহেতু ঐকমত্য কমিশনের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে তথ্য নেই এবং আমাদের পক্ষে সেটা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, এবং যেহেতু সরকারকে বলেছি তারা যেন আদেশ দেওয়ার পর এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান করে। আমরা এটা লিখিতভাবে বলেছি এবং এর বাইরে সরকারকে যেটা বলেছি সেটা হচ্ছে তারা যেন অবিলম্বে এবিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে আলাপ আলোচনা করে নির্বাচনের একটি তফসিল তৈরি করে ফেলে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আলী রিয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া আমরা জানি না। ফলে জুলাই সনদের ব্যাপারে যেকোন মতামত এক ধরণের স্পেকুলেশন (অনুমান নির্ভর তত্ত্ব)। আমরা আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচকভাবেই বিবেচনা করবে। জুলাই সনদে সংযোজন বিয়োজনের ক্ষেত্রে তারা কতটুকু যেতে পারবে। জাতীয় জুলাই সনদে যে অঙ্গীকার আছে সেই অঙ্গিকারের ভিত্তিতেই তাদেরকে কাজ করতে হবে। ঐকমত্য কমিশন যে বিষয়গুলোকে তফসিলের মাধ্যমে সংযুক্ত করে আদেশ দেওয়ার কথা বলছে, সেগুলোর ব্যাপারে কোন কোন দলের কিছু কিছু বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে। আমরা পরামর্শ দিয়েছি যে, আপনারা সম্মতির জন্য যান। তাদের সম্মতি নিন। তাতে জনগণ যদি সম্মত হতে রাজি না হয়, তাহলে অসম্মত বলে বিবেচনা করবো। আমরা ৪৮টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছি সেক্ষেত্রে আমরা জনগণের সম্মতি কিংবা অসম্মতির বিষয়টাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি জানান, আমরা দুটি বিকল্প দিয়েছি। তার অধিকাংশ বিষয় একই রকম। তার মধ্যে আদেশ জারি করা, গণভোট অনুষ্ঠান, জনগণের সার্বভৌম গাঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সংবিধান সংস্কার পরিষদ তৈরি করা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংশোধনী-সংযোজনী, পরিবর্তন পরিমার্জন করা। পার্থক্য হচ্ছে, গণভোটের তফসিলে অর্থাৎ গণভোটের জন্য আদেশে বিষয়টি বলা হবে, আসলে কি যাবে গণভোটে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে এখনই সাংবিধানিক ভাষায় পরিবর্তন করে বিলের আকারে দিতে পারে অথবা জুলাই জাতীয় সনদে যে ভাষায় লেখা আছে সেভাবেই। এটা সরকারের কাছে একারণে বলছি যে এই সময়ের মধ্যেই আমরা মনে করি বিল আকারে দেওয়া যাবে। একারণে সিদ্ধান্তটা সরকারের কাছে দিয়েছি। ফলে একটার চেয়ে আরেকটা শ্রেয় তা বিবেচনা করছি না। কারণ লক্ষ্য সুস্পষ্ট। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এই যে, জুলাই সনদে যা আমরা সকলে মিলে তৈরি করেছি, তা যেন বাস্তবায়িত হয়। তার জন্য যতটা সম্ভব সহযোগিতা করা। আমরা সেটাই করেছি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কন্সটিটিউশন রিফর্ম এসেম্বলির প্রথম এবং অন্যতম কাজ হচ্ছে জুলাই সনদে যা গৃহীত হয়েছে তা বাস্তবায়ন করা। ফলে এখানে আলোচনার মধ্য দিয়ে যা সিদ্ধান্ত হয়েছে, পরবর্তীতে যদি গণভোটের মধ্য দিয়ে জনগণের সম্মতি দাঁড় করানো যায়, তাহলে রিফর্ম কমিশনের দায়িত্ব হবে স্পিরিটের প্রতি অবিচল থাকা। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
তিনি বলেন এই সরকারের তিনটি এজেন্ডা। সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা সংস্কার প্রক্রিয়া ও বিচারকে এগিয়ে নিবেন। তাহলে সংস্কার ও নির্বাচনের দায়িত্ব যাদের, তারা এই কাজটি করতে পারবেন বলে মনে করি। আমরা এখন যে অবস্থায় আছি সেটা হলো স্টেট অব এক্সেপশন। এটা আমাদের বিবেচনায় নিয়েই অগ্রসর হতে হবে। সব কিছুই পুরনো বাক্সে ঢুকানো যাবে না। কিছু কিছু জিনিস বাক্সের বাইরেও রাখতে হবে।
আদেশের মধ্যে গণভোটের বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ লাগবে। সেটা সরকার তৈরি করবে। সেটা আদেশেরই অংশ। ফলে আমরা কোন দিনক্ষণ বেধে দিচ্ছি না। কিন্তু প্যাকেজ হিসেবে আমাদের সুপারিশ হচ্ছে, একটি প্রশ্ন। আপনি এই আদেশ এবং এই আদেশের তফসিলে যে বিষয়গুলো সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত আছে; তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করছেন কি-না ? যে কোন রেফারেন্ডামে এই বিষয়গুলো থাকে বলেও উল্লেখ করেন এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ-এ যা আছে :
সংষ্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ মালায় বলা হয়েছে, সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সফল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের প্রকাশ ঘটিয়াছে; গণঅভ্যুত্থানের ফলে ৫ আগস্ট ২০২৪ (২১ শ্রাবণ ১৪৩১) তারিখে তৎকালীন কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটে, ৬ আগস্ট ২০২৪ (২২ শ্রাবণ ১৪৩১) তারিখে জাতীয় সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয় এবং ৮ আগস্ট ২০২৪ (২৪ শ্রাবণ ১৪৩১) তারিখে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যাহা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকারিতা ও স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে; এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে সুশাসন, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং কর্তৃত্ববাদী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করিবার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থায় সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করে এবং উক্ত কমিশনসমূহ স্ব স্ব প্রতিবেদন সরকারের নিকট পেশ করে;
প্রতিবেদনগুলিতে অন্তর্ভুক্ত সুপারিশসমূহের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (২৯ মাঘ ১৪৩২) তারিখে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে; এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সহিত আলোচনাক্রমে সংবিধান সংস্কারসহ অন্যান্য সংস্কারের সুপারিশ সংবলিত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ প্রণয়ন করে এবং রাজনৈতিক দল ও জোট সম্মিলিতভাবে উক্ত সনদে স্বাক্ষর ও তাহা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে; সংবিধান সংস্কার বিষয়ে জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণের অনুমোদন প্রয়োজন এবং তদুদ্দেশ্যে গণভোট অনুষ্ঠান, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন ও উক্ত পরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কার অপরিহার্য;জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়ন সম্পন্ন করিবার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা একান্ত প্রয়োজন, সেহেতু সরকার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে এই আদেশ জারি করিল:-
১। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম।- এই আদেশ জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ নামে অভিহিত হইবে, যাহা অতঃপর “এই আদেশ” বলিয়া উল্লেখিত। ২। আদেশের প্রবর্তন ও কার্যকরতা।- জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফল হিসাবে প্রণীত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই আদেশ অবিলম্বে সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হইবে, এবং-(ক) উক্তরূপে গেজেট প্রকাশের তারিখে ইহার ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ১৩ ও ১৬ অনুচ্ছেদ কার্যকর হইবে; এবং(খ) ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদ গণভোটের ইতিবাচক ফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখে কার্যকর হইবে।৩। সংজ্ঞা।- বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থী কিছু না থাকিলে, এই আদেশে,-(ক) “গণভোট” অর্থ এই আদেশের অধীনে অনুষ্ঠিত গণভোট;(খ) “জাতীয় সংসদ” অর্থ সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে গঠিত জাতীয় সংসদ;(গ) “জুলাই গণঅভ্যুত্থান” অর্থ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থান, যাহার পরিণতিতে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে তৎকালীন সরকারের পতন ঘটে, ৬ আগস্ট ২০২৪ তারিখে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয় এবং ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়;(ঘ) “জুলাই জাতীয় সনদ” অর্থ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ এবং উক্ত কমিশন কর্তৃক স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫;(ঙ) “নির্বাচন কমিশন” অর্থ সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী গঠিত নির্বাচন কমিশন;(চ) “নির্বাচিত প্রতিনিধি” অর্থ সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে গঠিত জাতীয় সংসদের সকল সংসদ-সদস্য;(ছ) “পরিষদ” অর্থ এই আদেশের ৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে গঠিত সংবিধান সংস্কার পরিষদ;(জ) “সভাপ্রধান” অর্থ এই আদেশের ১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে পরিষদের সভায় সভাপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তি;(ঝ) “সংবিধান” অর্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান; এবং(ঞ) “সংসদ নির্বাচন” অর্থ এই আদেশ জারির অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন।
৪। জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট।- জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত অংশ গণভোটে উপস্থাপন করা হইবে।৫। গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপনীয় প্রশ্ন ।- (১) গণভোটে নিম্নরূপ প্রশ্ন উপস্থাপন করা হইবে -‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’।(২) ব্যালটের মাধ্যমে গণভোট অনুষ্ঠিত হইবে এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ব্যালটে প্রত্যেক ভোটার গোপনে ভোটদান করিবেন।৬। গণভোট অনুষ্ঠান।- এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা উক্ত নির্বাচনের দিন এই আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা হইবে।৭। গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য আইন প্রণয়ন।- গণভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে যথোপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হইবে।৮। সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন ও উহার কার্যাবলি।- (১) গণভোটে উপস্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে প্রদত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ইতিবাচক (হ্যাঁ সূচক) হইলে-
(ক) এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হইবে, যাহা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (ঈড়হংঃরঃঁবহঃ চড়বিৎ) প্রয়োগ করিতে পারিবে;(খ) উক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ একইসাথে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসাবে এবং এই আদেশ অনুসারে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করিবেন;(গ) পরিষদ উহার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হইতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এই আদেশের তফসিল-১ এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করিবে এবং তাহা সম্পন্ন করিবার পর পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হইবে।(২) পরিষদের কার্যধারায় অংশগ্রহণের সময় নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ পরিষদ-সদস্য হিসাবে অভিহিত হইবেন।(৩) এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, পরিষদ ইহার অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবি, সংবিধান সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপনের পদ্ধতি, উক্ত প্রস্তাব বিবেচনা ও গ্রহণ এবং অন্য সকল বিষয়ে কার্যপ্রণালি নির্ধারণ করিবে। (৪) জাতীয় সংসদ সচিবালয় পরিষদকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করিবে।
৯। শপথ এবং শপথ-পাঠ পরিচালনা।- (১) নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সংসদ-সদস্য হিসাবে শপথ গ্রহণের পর একই শপথ অনুষ্ঠানে এই আদেশের তফসিল-২ অনুযায়ী পরিষদ-সদস্য হিসাবে শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা (এই অনুচ্ছেদে “শপথ” বলিয়া অভিহিত) করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন।(২) সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ-সদস্যদের ক্ষেত্রে যিনি শপথ-পাঠ পরিচালনা করিবেন তিনিই এই আদেশের তফসিল-২ এ বিধৃত ফরমে পরিষদ-সদস্যদের শপথ-পাঠ পরিচালনা করিবেন।
১০। পরিষদের সভাপ্রধান, ইত্যাদি।- (১) পরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম বৈঠকে পরিষদ-সদস্যগণ ইহার সভাপ্রধান ও উপ-সভাপ্রধান নির্বাচন করিবে; এবং উক্তরূপ নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত পরিষদের বয়োজ্যেষ্ঠ একজন সদস্য বৈঠকে সভাপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করিবেন।(২) সভাপ্রধান ও উপ-সভাপ্রধান উভয়ের অনুপস্থিতিতে পরিষদের কার্যপ্রণালী অনুযায়ী কোন পরিষদ-সদস্য সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করিবেন।
১১। পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, কোরাম, ভোটদান, ইত্যাদি।- (১) সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষিত হইবার ৩০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যে পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হইবে অনুরূপ পদ্ধতিতে পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হইবে।(২) পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ৬০ (ষাট) জন পরিষদ-সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন হইবে।(৩) সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিষদের মোট সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে; এবং অন্যান্য বিষয়ে উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইবে:তবে শর্ত থাকে যে, সমসংখ্যক ভোটের ক্ষেত্র ব্যতীত সভাপ্রধান ভোটদান করিবেন না এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে তিনি নির্ণায়ক ভোট প্রদান করিবেন।
১২। পরিষদ ও উহার সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি।- পরিষদের কোনো কার্যধারার বৈধতা এবং পরিষদ-সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তি জাতীয় সংসদ ও সংসদ-সদস্যদের অনুরূপ হইবে।
১৩। জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ।- জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা অনুসারে সংবিধানে জুলাই জাতীয় সনদ অন্তর্ভুক্ত হইবে।
১৪। সংবিধান সংস্কার অবিলম্বে কার্যকর করা।- (১) এই আদেশের ৮ অনুচ্ছেদের উপঅনুচ্ছেদ (১)(গ) অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন হইবার পর যে সমস্ত সংস্কার অবিলম্বে কার্যকর করা সম্ভব তা অবিলম্বে কার্যকর করা হইবে এবং এক্ষেত্রে সরকার সকল যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।(২) এই অনুচ্ছেদের উপঅনুচ্ছেদ (১) এর সাধারণতা ক্ষুণœ না করিয়া [without prejudice to the generality of sub-article (1)] এই আদেশের ৮ অনুচ্ছেদের উপঅনুচ্ছেদ (১)(গ) অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন হইবার পর ৪৫ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation-PR) পদ্ধতিতে একটি উচ্চকক্ষ গঠন করা হইবে।(৩) এই অনুচ্ছেদের উপঅনুচ্ছেদ (২) অনুসারে গঠিত উচ্চকক্ষের মেয়াদ শপথ গ্রহণের তারিখ হইতে এই আদেশ জারির অব্যবহিত পরে গঠিত নিম্নকক্ষের (জাতীয় সংসদের) মেয়াদের শেষ দিবস পর্যন্ত হইবে।(৪) এই আদেশ জারির অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের সময় উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের প্রয়োজন হইবে না।(৫) এই অনুচ্ছেদের উপঅনুচ্ছেদ (২) অনুসারে উচ্চকক্ষ গঠনের ক্ষেত্রে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্দেশ্যে পরিষদ প্রয়োজনীয় বিধান প্রণয়ন করিতে পারিবে এবং সরকার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করিতে পারিবে।
১৫। পরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কার চূড়ান্তকরণ ও প্রকাশ।- (১) সার্বভৌম জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তির ভিত্তিতে পরিষদ গঠিত বিধায় তৎকর্তৃক গৃহীত সংবিধান সংস্কার চূড়ান্ত হইবে এবং উক্তরূপ সংস্কার বিষয়ে অন্য কোনোভাবে অনুমোদন বা সম্মতির প্রয়োজন হইবে না।(২) পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান সংস্কারের পূর্ণাঙ্গ পাঠ এবং উক্তরূপে সংস্কারকৃত সংবিধানের পূর্ণাঙ্গ পাঠ অনতিবিলম্বে সরকার সরকারি গেজেটে প্রকাশ করিবে।
১৬। সরকার কর্তৃক নির্দেশনা ইত্যাদি জারি।- এই আদেশের বিধানাবলি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করিতে পারিবে।