বিগত সরকারের আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে না হলেও সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলে জানিয়েছেন গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সভাপতি বিচারপতি (অব.) মইনুল ইসলাম চৌধুরী।
বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) দুপুরে রাজধানীর গুলশানে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি আরও জানান, গুম হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই হত্যা, অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা, নির্যাতন বা ভয়ভীতির শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, এই গুমের ঘটনাগুলো মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ঘটানো হতো। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও ভারতীয় গোয়েন্দারাও এতে জড়িত ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি মইনুল ইসলাম বলেন, গুমের ঘটনায় র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই-এর কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন—এগুলো এমন প্রতিষ্ঠান, যেখানে সেনা সদস্যরাই মূলত নেতৃত্বে থাকেন। আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব সংস্থার মাধ্যমে অনেক গুম সংঘটিত হয়েছে। যদিও প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী জড়িত ছিল না, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যে জানতেন না, এমনটা বলা যাবে না।’
বৃহস্পতিবার ঢাকার গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বিচারপতি মইনুল। তিনি জানান, গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনে যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিটি প্রধানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গুম হওয়া ব্যক্তিদের চার ধরনের পরিণতি হতো। যেমন- অনেককেই হত্যা করা হয়েছে; কাউকে কাউকে জঙ্গি তকমা দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছিল; সীমান্ত পার করে ভারতে পাঠিয়ে দেশটির আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তার করানো হয়েছিল অনেককে। আবার কারও ভাগ্য খুব বেশি ভালো হলে অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সভাপতি বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, কমিশনে জমা পড়া ১ হাজার ৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত ২৫৩ জন গুমের শিকার ব্যক্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তিনি আরও জানান, তদন্ত কমিশনে জমা দেওয়া অভিযোগগুলোর মধ্যে ৮১ শতাংশই জীবিত ভিকটিমদের নিয়ে, যারা গুম থেকে ফিরে এসেছেন। বাকি ১৯ শতাংশ অভিযোগ এমন ভিকটিমদের নিয়ে, যারা এখনো ফেরত আসেননি।
তিনি বলেন, গুম হয়ে ফিরে না আসা ১২ জনের বিষয়ে আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধান সম্পন্ন করেছি এবং তাদের গুমের পেছনে কারা জড়িত, তা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতেও সক্ষম হয়েছি। চলমান অনুসন্ধানের স্বার্থে এই মুহূর্তে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ফিরে না আসা ভিকটিমদের আরও অনেকের বিষয়েই কমিশনের কাজের অগ্রগতি রয়েছে জানিয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একেকজন ভিকটিমের বিষয়ে অনুসন্ধান সম্পন্ন করার আগে তথ্য প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। ফিরে না আসা ভিকটিমদের বিষয়ে অপরাধী এবং গুমের অপরাধ সংঘটনের স্থানসহ নানাবিধ বিষয়ে তথ্যের ঘাটতি বা পুরনো কললিস্ট না পাওয়াসহ নানা রকম বিলম্ব ঘটিত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলেও কমিশন আন্তরিকতার সঙ্গে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
সন্ত্রাসবাদ সারা বিশ্বে একটি বাস্তব হুমকি-বাংলাদেশও এর বাইরে নয় উল্লেখ করে গুম কমিশনের সভাপতি বলেন, ২০১৬ সালের হলি আর্টিজানে হামলার মতো ঘটনা এর প্রমাণ। তবে এই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সততা, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অটল থাকা জরুরি। সরকার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণাকে যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তা আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠান ও জনগণের বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দেয়।
গুমের সঙ্গে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সবচেয়ে বেশি জড়িত উল্লেখ করে মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এতে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের পাশাপাশি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীরাও জড়িত। বাংলাদেশে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভারতীয় যারা জড়িত, তাদের বিষয়ে আমরা কিছু করতে পারব না।
আরেক সদস্য মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ভারতে বন্দি থাকা বাংলাদেশিদের তথ্য চেয়েছি। এদের মধ্যে গুমের কেউ আছে কিনা খতিয়ে দেখছি। পুশ-ইন যাদের করা হচ্ছে, এদের মধ্যে কেউ গুমের শিকার কিনা খতিয়ে দেখছি।