তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শুরু হয়েছে। রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এবারের ডিসি সম্মেলনে সারা দেশ থেকে ৩৫৩টি প্রস্তাব উঠছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। এছাড়াও জনসেবা, জনদুর্ভোগ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, আইনকানুন ও বিধিমালা সংশোধন এবং জনস্বার্থের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এই সম্মেলনে।
সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের নিজ নিজ শহরে বিশেষ বিশেষ কিছু নিদর্শন রেখে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের নামে কোথাও কোনো কিছু হবে না। এমনকি সরকারে যারা আছেন তারা কোথাও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতেও যাবেন না।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ সবার দাবি-দাওয়া মেটানো নয়, বরং একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ। একটি সুন্দর নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরা আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারেন।
রোববার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের প্রথম দিন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্য-অধিবেশন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে সামনে নির্বাচন আসছে, সেই নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু করা যায় সেটিই আমাদের সরকারের প্রধান কাজ। সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরা সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
তিনি বলেন, আরেকটা পরামর্শ দিয়েছি, যেহেতু তারা (জেলা প্রশাসকরা) নিজ নিজ এলাকায় ছোট একটি শহরে থাকেন, সেই শহরগুলোতে আমরা ছোটবেলায় যা দেখেছি, তখনকার দিনে যারা জেলা প্রশাসক ছিলেন বা মহকুমার প্রশাসক ছিলেন তারা কিন্তু একটা কিছু (নিদর্শন) সেই শহরের জন্য রেখে যেতেন। সেটা হোক একটি সুন্দর দিঘি, স্টেডিয়াম, স্কুল বা একটি সুন্দর পার্ক।
‘আমি ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিয়েছি আপনারা আপনাদের প্রতিটি শহরে যেখানে যে আছেন একটা কিছু আপনাদের নিদর্শন রেখে যাবেন। যেন অনেক পরেও সবাই বলতে পারে আপনি ওই শহরের প্রশাসক ছিলেন। এটি আমার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা থেকে বললাম।’
শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরও বলেন, আগে জেলা প্রশাসকের নামে অনেক কিছু হতো। আজকে সবকিছুই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে হয়, প্রশাসকদের নামে কিছু হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা আছেন তাদের নামে কোথাও কোনো কিছু হবে না। আমরা কোনো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে যেতে চাই না, আমাদের একমাত্র কাজ হলো একটি সুন্দর নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া।
আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে দুষ্কৃতকারীদের শায়েস্তা করতে ডিসিদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম।তিনি বলেছেন, ‘আমাদের আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। তাই আইন প্রয়োগ করে দুষ্কৃতকারীদের শায়েস্তা করার কথা ডিসিদের বলেছি।’
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা রোববার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের প্রথম দিন বিকেলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বিষয়ক কার্য অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের একথা বলেন।
নূরজাহান বেগম বলেন, আজকে জেলা প্রশাসকরা নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন। বিশেষ করে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ সংক্রান্ত নানা সমস্যার কথা বলেছেন। সেসব সমস্যার মধ্যে আমরা কিছু কিছু সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। তবে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো আমাদের প্রতিরোধমূলক কিছু করা উচিত। এই যে হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস হচ্ছে এগুলোর কারণগুলো কি? কীভাবে হয়, মানুষকে কিভাবে সচেতন করতে পারি।
তিনি বলেন, ট্যোবাকো নিয়ে কী করতে পারি, ছোট ছোট বাচ্চারা ই-সিগারেটে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। সেগুলোকে আমরা কীভাবে প্রতিরোধ করতে পারি। আমাদের সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা নিয়ে কোন আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, এ পর্যন্ত আমরা ৪০ জন আহত রোগীকে সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছি, টাকার দিকে তাকাইনি। আমরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন জানতাম না এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কোথায় পাওয়া যায়। কিন্তু তড়িৎ গতিতেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে আহতদের বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আমরা তাদের সর্বোত্তম চিকিৎসা দিতে চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ডাক্তার এনে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নূরজাহান বেগম বলেন, আহতদের কিছুটা অসন্তুষ্টি আছে, সেটা এক শতাংশও হবে না। তবে কেউ যখন এক থেকে তিন সপ্তাহ বিছানায় পড়ে থাকে তখন তো একটা ট্রমা কাজ করে। এরা তো গত ছয় মাস ধরে পা ভেঙ্গে, পা-হাড়িয়ে, হাত হারিয়ে, চক্ষু হারিয়ে বসে আছে। তাদের ট্রমা আস্তে আস্তে কমে যাবে। তাদের রিহেবিলিটেশন করার পরিকল্পনাও রয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যদের সমন্বয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে এগুলো আর থাকবে না।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে সকলকে একটি টিম গঠন এবং এই টিমে এনজিওদের অংশীদার করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন জেলার হাসপাতালে লোকবলের সমস্যা সমাধান, কমিউনিটি হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ, সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার জন্য এনজিওদের সাথে সমন্বয় করে ওয়ার্কফোর্স তৈরির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
হাসপাতালে নির্মাণকাজে ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ে সহযোগিতা প্রদানের বিষয়ে আলোচনা কথা জানিয়ে নূরজাহান বেগম বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, ভেজাল খাদ্য বিক্রেতা/উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা, গ্রামাঞ্চলের ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ডিসিদের বলা হয়েছে।
বৈঠকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার কার্যক্রম জোরদার করার বিষয়ে ডিসিদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান উপদেষ্টা।
এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে আমরা যা পেয়েছি তা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের মধ্যে কিছু জায়গায় অসঙ্গতি যেমন- জনবল, অবকাঠামো আছে কিন্তু কার্যক্রম নেই, হাসপাতালের শয্যা নিয়ে সমস্যার কথা তারা বলেছেন। কিছু কিছু জায়গায় মেডিকেল কলেজের চাহিদা আছে, সেগুলো করার কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় এককভাবে স্বাস্থ্যখাতে বৈষম্য দূর করতে পারবে না, এখানে আমরা তাদের সাহায্য চেয়েছি। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, জেলা প্রশাসন এবং বিভাগীয় কমিশনার যদি সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন তাহলে আরেকটু ভালো স্বাস্থ্যসেবা আমরা দিতে পারবো।
সায়েদুর রহমান বলেন, পাঁচ হাজার চিকিৎসক আমাদের প্রাথমিক স্তরেই প্রয়োজন। এছাড়া বিশেষজ্ঞ পদ এবং আধুনিক হাসপাতালে কিছু পদের প্রয়োজনীয়তা আছে। পদ সৃষ্টি করার আর্থিক সিস্টেম একটি লম্বা প্রক্রিয়া। কিন্তু ইতোমধ্যে আমরা পাঁচ হাজার পদ সৃজনের কাজ শুরু করেছি। এই পদ যদি সৃষ্টি করে দিতে পারি তাহলে সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে।