দেশে জাতীয় আয় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকায় অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী হচ্ছে। বিশেষ করে প্রবাসী আয় তথা রেমিটেন্স এবং রফতানি আয় পূর্ববর্তী অর্থ বছরের তুলনায় বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে। তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থ বছরের চেয়ে রফতানি আয় শতকরা ৮.৬ ভাগ এবং রেমিটেন্স শতকরা ২৬.৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির শীর্ষে অবস্থান করছে যথাক্রমে মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। এই হিসাব শীর্ষ ১০টি দেশের।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, দেশে রফতানি আয় ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ছিল ৪৪ হাজার ৪৭৪ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ২৯৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় এই বৃদ্ধির হার শতকরা ৮ দশমিক ৬ ভাগ। অন্যদিকে ১০টি শীর্ষ দেশের প্রবাসী আয় তথা রেমিটেন্সের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে আয় ছিল ২৩ হাজার ৯১২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এর পরিমাণ ৩০ হাজার ৩২৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধির হার ২৬ দশমিক ৮ ভাগ।
সূত্রে জানা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ব্যাংকের টাকা লুট এবং আমদানি-রফতানির নামে বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ব্যাংক রিজার্ভ প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকে। তবে গত এক বছরের ব্যবধানে এই রিজার্ভ সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে বিদেশে পণ্য রফতানি বাবদ আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে আয়। রফতানিযোগ্য প্রায় প্রতিটি পণ্যেরই রফতানি বেড়েছে এবং পূর্ববর্তী অর্থ বছরের তুলনায় এই আয় রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করেছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকা মোতাবেক মূল ১৪টি শিরোনামে অন্তত ৭০টি পণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, কৃষি পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, বিশেষায়িত বস্ত্র পণ্য, মৎস ও মৎসজাত পণ্য, প্রকৌশল পণ্য, কেমিকেলজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, কাগজ ও কাগজজাত পণ্য প্রভৃতি।
রফতানির তুলনামূলক চিত্র
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত পণ্য ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জুলাই-জুন সময়কালে বিদেশে রফতানি হয় ৪৩ হাজার ১৩২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রফতানি হয় ৪৬ হাজার ৮৬৭ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৭ ভাগ। প্রস্তুতকৃত পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান নিয়ে আছে গার্মেন্টস শিল্প। কৃষিজাত পণ্য ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রফতানি হয় ৯৬৫ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রফতানি হয় ৯৯০ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৬ ভাগ। হিমায়িত ও জীবিত মাছ গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রফতানি হয় ৩৭৭ দশমিক ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধির হার ১৭ দশমিক ২ ভাগ।
প্রবাসী আয়ের চিত্র
শীর্ষ ১০টি দেশের প্রবাসী আয় তথা রেমিটেন্স বাবদ আয়ের হিসাবে দেখা যায়, পূর্ববর্তী অর্থ বছরের তুলনায় অধিক পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জুলাই-জুন সময়কালে এই দেশ থেকে অর্থ অসার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৪৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এসেছে ২ হাজার ৮০৪ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধির হার ৬০ দশমিক ৮ ভাগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে যথাক্রমে ২ হাজার ৯৬১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ও ৪ হাজার ৭৩৩ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধির হার ৫৯ দশমিক ৮ ভাগ। সৌদি আরব থেকে এসেছে যথাক্রমে ২ হাজার ৭৪১ দশমিক ৪ মিলিয়ন ও ৪ হাজার ২৬৪ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার। বৃদ্ধির হার ৫৫ দশমিক ৬ ভাগ। এছাড়া অন্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ইটালি, ওমান, কুয়েত, কাতার, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি।
বাংলাদেশের যে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স আহরিত হয় তার তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। এর পর যথাক্রমে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, জনতা, কৃষি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, সোনালী, রূপালী, সিটি ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংক।
রিজার্ভ সমৃদ্ধ হচ্ছে
রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসায় দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত ২১ আগস্ট পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৮৫৬ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন (৩০.৮৫ বিলিয়ন) ডলার। এর আগে গত ১৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮০৯ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার। সূত্র মতে, প্রধানত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রবাসীরা বৈধ পথে আয় পাঠানোর পরিমাণ বাড়িয়েছেন- যা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। রিজার্ভ বৃদ্ধির ফলে দেশ এখন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রভাবে টাকার ওপর চাপ কমবে, ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে আস্থা ফিরে আসবে এবং ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দিয়ে অন্তত সাড়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, গত বছর জুন থেকে মধ্য আগস্ট পর্যন্ত টানা রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পটপরিবর্তনের কারণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে বিঘœ ঘটে। এছাড়াও পরে শ্রমিক অসন্তোষ পোশাক শিল্পে উৎপাদনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হয় এবং অর্থনীতির সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়ায়। ফলে মুদ্রার রিজার্ভ শক্ত ভিত্তি পায়।