বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি স্কুলে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ৩৪ জন নিহত হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই স্কুলটির শিক্ষার্থী, যাদের বেশিরভাগের বয়সই ১৪ বছরের নিচে।
গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। এর কোনোটিতে পাইলট আহত বা নিহত হয়েছেন। কোনোটি বিধ্বস্ত হয়েছে জনবসতি থেকে দূরে।
তবে, এবার শুধু ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নয়, যুদ্ধ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে ক্লাস চলাকালে একটি স্কুল ভবনে। আর এতে নিহত ও আহত হয়েছে স্কুলটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।
বিশ্বে কোথাও বাণিজ্যিক বিমান দুর্ঘটনার শিকার হলে আইন অনুযায়ী, ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকেন নিহত ও আহতের পরিবার।
স্কুলের উপর এই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, অপূরণীয় এই ক্ষতির বিপরীতে প্রতিকার কি আছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কী আইনি সুরক্ষা বা ক্ষতিপূরণ পেতে পারে?
জবাবে, আইনজীবী ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে টর্ট আইন নামক একটা ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কৃতকর্মের কারণে অন্য কারো ক্ষতি হলে তার প্রতিকার পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে টর্ট আইন নামে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তবে এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রচলিত দেওয়ানি বা ফৌজদারি আইনে মামলা করে ক্ষতিপূরণ, বিচার বা প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।
আইনজীবীরা বলছেন, দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবার, ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন বা উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন। এখানে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পেশা, আয়, এবং সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বিবেচনা করে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কাজী জাহেদ ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বাংলাদেশের আইনে টর্ট বা ক্ষতিপূরণের জায়গাটা অনেক দুর্বল। অন্যদিকে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এসব মামলার নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লাগে। যে কারণে অনেকে খুব একটা আগ্রহ পান না"।
এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হাইকোর্টে একটি রিট হয়েছে। যেখানে নিহত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন, নিম্ন আদালতের বাইরে উচ্চ আদালতে এই বিষয়টি সুরাহা হলে তুলনামূলক কম সময়ে আইনি প্রতিকার পেতে পারেন আহত ও নিহতদের পরিবারগুলো।
তবে আইনজীবীরা বলছেন, বাংলাদেশে আইনের এই গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি আমাদের দেশের আইন অঙ্গনে উপেক্ষিত থাকায় এর প্রয়োগ ও প্রতিকার সম্পর্কে অনেকেরই অজানা।
যে কারণে এই ধরনের ক্ষেত্রে অনেক সময় শুধুমাত্র ফৌজদারি মামলা হয়। তখন ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও অনেক পেছনে পড়ে যায়।
টর্ট আইন কী ও কেন?
টর্ট ল' বা ক্ষতিপূরণ আইন হচ্ছে এমন একটি আইনি ক্ষেত্র, যা তখন প্রযোজ্য হয় যখন কেউ অন্য কারো ক্ষতি করে এবং সেই ক্ষতির জন্য তাকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।
ল্যাটিন টর্টাম থেকে টর্ট শব্দটি উৎপত্তি, যার অর্থ অন্য কারো ক্ষতিসাধন করা।
বাংলাদেশে সরাসরি টর্ট আইন নামে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তবে ক্ষতি বা অবহেলার শিকার হলে বিভিন্ন আইনেও আওতায় ক্ষতিপূরণ বা প্রতিকার দাবী করা যায়। এভাবে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারের আইনকে মূলত টর্ট আইন বলে অনেকে বর্ণনা করে থাকেন।
অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি কেউ অপরাধী না হলেও তার কাজের বা অবহেলার ফলে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে বা ওই প্রতিষ্ঠানকে দায় নিতে হয়।
একটু সহজভাবে বললে, অন্যের ক্ষতির জন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের যে সংস্থা, কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তি দায়ী, তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করে এ জাতীয় আইনগুলো।
উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ঢাকা শহরে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। সেই সময়ে নির্মাণাধীন ভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ইট পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে।
ভবন নির্মাণের সময় যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেওয়ায় পথচারীর মৃত্যুর ঘটনাটি একটি অবহেলা জনিত ঘটনা।
ফলে এই দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার দেওয়ানি মামলা বা সিভিল স্যুটে এর প্রতিকার চাইতে পারেন। এসব আইনের মধ্যে রয়েছে পেনাল কোড, গুরুতর দুর্ঘটনা আইন, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন অথবা সিভিল প্রসিডিউর কোড, শ্রম আইন। পারিবাকি আইন, মোটরযান আইনসহ অন্য আরো কিছু আইনে ক্ষতিপূরণ বা প্রতিকার চাওয়া যায়। এর বাইরে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী অধিকার দাবি করতে পারেন।
আইনজীবী জাহেদ ইকবাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ধরেন মাথায় ইট পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় ওই ভবনের মালিক যিনি তার দায় আছে। দ্বিতীয়ত ওই ভবন নির্মাণের সাথে যারা জড়িত এই ঘটনায় তারাও একই ভাবে দায়ী।
মি. ইকবাল বলছিলেন, ভবনের মালিক, নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও এই ঘটনায় সিটি কর্পোরেশন, রাজউক কিংবা সংশ্লিষ্ট অথরিটিও দায়ী হতে পারেন কেননা যাদের এটি দেখভাল করার কথা তারা সেটি সঠিকভাবে করেন নি।
আইনজীবীদের মতে, এক্ষেত্রে ওই ভবন মালিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও দেওয়ানি দুই ধরনের অপরাধেই মামলা হতে পারে। সেসব আইনের আলোকে ক্ষতিগ্রস্তের পরিবার ক্ষতিপূরণও পেতে পারেন।
বাংলাদেশে যেমন ঢাকার শাহজাদপুরে রেলওয়ে কলোনিতে ২০১৪ সালে খোলা পাইপের মধ্যে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রেলওয়ে এবং ফায়ার সার্ভিসকে আদেশ দিয়েছিল আদালত।
চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। ইন্সুরেন্স কোম্পানি, বাস চালক ও বাস কোম্পানিকে এসব ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছিল।
এছাড়া ইউনাইটেড হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনায়, ফ্লাই ওভারের গার্ডার পড়ে নিহত ও আহত হওয়ায় নিহতদের পরিবার ও আহতদেরকে, ঢাকার চকবাজার অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পরিবারকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়েছিল আদালত।
প্রতিকার বা ক্ষতিপূরণ হবে কীভাবে?
যে কোনো দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ক্ষতিপূরণ টাকা বা আর্থিক মূল্য দিয়ে পরিশোধ করা কখনোই সম্ভব না।
আনুষঙ্গিক ক্ষতির জন্য কেবল মামলা করার মাধ্যমেই ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব। এ ধরনের ক্ষতিপূরণ আদায়ের আইনগুলোকেই অনেক সময় টর্ট আইন হিসাবে বর্ণনা করা হয়। যদিও বাংলাদেশে সরাসরি টর্ট আইন নামে কোনো আইন নেই। তবে ঘটনার প্রকারভেদে বিভিন্ন আইনের ধারা ও বিধান অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ, জরিমানা বা দণ্ড দেওয়া হতে পারে।
আইনজীবীরা বলছেন, এই আইনের মাধ্যমে আর্থিক জরিমানাই বেশি দেওয়া হয়ে থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি বা সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের আদেশ দেওয়া হয়ে থাকে।
আধুনিক বিশ্বে টর্ট আইনের মাধ্যমে মানসিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও চালু আছে কোথাও কোথাও।
আইনজীবী জাহেদ ইকবাল বলেন, "এসব ঘটনা ও টর্ট আইনে মামলার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ আদায়ে অনেক কিছু বিবেচনা করা হয়। যেমন ক্ষতিপূরণ কিভাবে দেয়া হবে, লাইফ টাইম কতদিন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সমাজ বা রাষ্ট্রে কী ধরনের অবদান রাখতে পারতো, এর সবই বিবেচনায় নিয়ে আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করে থাকে"। আইনজীবীরা বলছেন, বাংলাদেশে এ ধরনের ক্ষতিপূরণ দাবির বিষয়টি দেশের আইন অঙ্গনে উপেক্ষিত থাকায় এর প্রয়োগ ও প্রতিকার সম্পর্কে অনেকেরই অজানা।
আইনজীবী মি. ইকবাল বলছিলেন, বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, বা ব্যক্তিকে আদালতের রায়ে এই ধরনের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘটনা ঘটলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের এমন ক্ষতিপূরণ দেয়ার নজির এখনো পর্যন্ত দেখা যায় নি।
"বাংলাদেশে আদালতের রায়ের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেকে এই আইনের প্রতিকারের জন্য খুব একটা আগ্রহী হয়ে ওঠে না। যে কারণে অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিকার পান না, বলছিলেন মি. ইকবাল।
আইনজীবীরা মনে করেন, টর্ট আইনের ব্যাপক প্রয়োগ থাকলে এই আইনের মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনায় সুনির্দিষ্ট প্রতিকার পাওয়া সম্ভব হতো ক্ষতিগ্রস্তদের।
মাইলস্টোনের বিমান দুর্ঘটনার উদাহরণ টেনে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, "শুধু আইনি প্রতিকার নয়, এই ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। এই ধরনের হত্যাকাণ্ড অবহেলা জনিত কারণে না ঘটে সেটাও এক ধরনের ক্ষতিপূরণ"।
মাইলস্টোনের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা নতুন নয়। গত এক দশকে বিমান বাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে আগের ঘটনাগুলোতে পাইট নিহত বা নিখোঁজের ঘটনা ঘটলেও বেসামরিক মানুষ হতাহতের বড় কোনো উদাহরণ নেই।
গত সোমবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা এ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিমান বিধ্বস্তের সবচেয়ে মর্মান্তিক উদাহরণ।
ওই দুর্ঘটনার পরদিন নিহতদের পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা ও আহত এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনিসুর রহমান রায়হান জনস্বার্থে এই রিট দাখিল করেন। একই সাথে এই রিটে সরকারকে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
এছাড়াও ত্রুটিপূর্ণ বিমান ও যুদ্ধবিমান জনবহুল এলাকার ওপর দিয়ে ওড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি অনুরোধ জানানো হয় রিটে। আইনজীবীরা বলছেন, এই রিটের প্রেক্ষিতেও মাইলস্টোনের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব।
আইনজীবী জাহেদ ইকবাল বলছিলেন, সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী টর্ট আইনের মামলাগুলো নিম্ন আদালতে করতে হয়। কিন্তু নিম্ন আদালতে এই মামলার শুনানি ও রায় অনেক দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়।
অতীতের কয়েকটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছিলেন, এই ধরনের মামলার শুনানি ও বিচার পেতে বছরের পর বছর এমনি দুই দশক সময়ও ব্যয় হয়। যে কারণে অনেকেই এভাবে প্রতিকার পেতে আগ্রহী হন না।
তবে মাইলস্টোনের এই ঘটনায় হাইকোর্টে যে রিটটি হয়েছে সেই রিটের ভিত্তিতে দ্রুত প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণ আদায় সম্ভব বলে আইনজীবীরা মনে করেন।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ঘটনায় বিমান বাহিনীকে যদি ক্ষতিপূরণ দিতে হয় তাহলে অনেকগুলো বিষয় সামনে আসবে।
বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক নাফিজ ইমতিয়াজ উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, "দুর্ঘটনায় নিহত প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান। যখন ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন আসবে তখন স্বাভাবিকভাবে দুর্ঘটনায় নিহত পাইলটের বিষয়টি হয়তো কাভার করবে। সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ার বিষয়টি কাভার করে কী-না সেটিও বড় প্রশ্ন"।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।