অপতথ্য মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং গণমাধ্যমকে নৈতিক মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইউনেস্কোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি সুসান ভাইজ ও ইউনেস্কোর ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা’ বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রকল্প কর্মকর্তা মেহদি বেনচেলাহ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ আহ্বান জানান।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং ইউনেস্কোর যৌথভাবে প্রস্তুত করা ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিম-লের মূল্যায়ন : স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও বহুমাত্রিক গণমাধ্যমের দিকে মনোনিবেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশের আগে তারা এ সাক্ষাৎ করেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা এই প্রতিবেদনের জন্য সত্যিই অপেক্ষা করছি। তিনি বলেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হলো অপতথ্য, ভুয়া সংবাদ। আর এসব অপতথ্যের কিছু ছড়ায় বিদেশে থাকা লোকজন, আবার কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয়রাও এতে জড়িত। ধারাবাহিকভাবে এ হামলা হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শুধু ডিজিটাল মাধ্যমে নয়, নিয়মিত প্রচারিত গণমাধ্যমও অনেক সময় ভুয়া তথ্যের উৎস হয়ে ওঠে।’ এ প্রেক্ষিতে তিনি জাতিসংঘের সক্রিয় ভূমিকা কামনা করে বলেন, ‘আপনারা শুধু সরকারের সঙ্গেই কথা বলবেন না, গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলুন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। যদি কোনো গণমাধ্যম বারবার মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, তাহলে তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত তারা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেন, আপনারা জাতিসংঘ, আপনাদের কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ...আপনাদের সমর্থন আমাদের প্রয়োজন। ইউনেস্কো প্রতিনিধি সুসান ভাইজ বলেন, বৃহস্পতিবার প্রকাশিতব্য প্রতিবেদনটিতে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও তুলে ধরা হবে।

তিনি বলেন, প্রতিবেদনটি দেখাবে কী কার্যকর হচ্ছে, আর কী হচ্ছে না এবং এতে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ থাকবে। সরকারি কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগের সদস্যদের আন্তর্জাতিক মানের সাথে তাদের কার্যক্রম সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে- সে বিষয়টিও উল্লেখ থাকবে। ইউনেস্কোর জ্যেষ্ঠ প্রকল্প কর্মকর্তা মেহদি বেনচেলাহ বলেন, প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ এবং নারী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কেও কিছু সুপারিশ থাকবে, যা একটি বৈশ্বিক উদ্বেগ। সরকারি পদক্ষেপ এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রতিবেদনটি ইউএনডিপির ‘প্রতিষ্ঠান, নীতি ও সেবা শক্তিশালীকরণ (এসআইপিএস)’ প্রকল্পের আওতায় এবং ইউনেস্কোর মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যম উন্নয়ন সংক্রান্ত ম্যান্ডেটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।

জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর টাস্কফোর্সের সুপারিশ পেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা: বাংলাদেশের জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর টাস্কফোর্সের চূড়ান্ত সুপারিশপত্র মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনায় গঠিত জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর টাস্কফোর্সে সরকার, বেসরকারি খাত, শিক্ষাবিদ এবং নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি (এনআরবি) কমিউনিটির প্রতিনিধিদের সমান অংশগ্রহণ রয়েছে। গতকাল প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

টাস্কফোর্সের মূল কাজ ছিল বাংলাদেশের জন্য চাহিদা ও ঘাটতি মূল্যায়ন ও সম্ভাবনা শনাক্তকরণ এবং স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও সক্ষমতা বৃদ্ধির সুপারিশ প্রদান করা।

সেমিকন্ডাক্টর ভ্যালু চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে (ডিজাইন, ফ্যাব্রিকেশন, টেস্টিং ও প্যাকেজিং) প্রতিযোগিতা করার জন্য বাংলাদেশের সক্ষমতা কতটা রয়েছে, তা বিশ্লেষণ করেছে টাস্কফোর্স। তারা সুপারিশ করেছে, স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে বাংলাদেশের উচিত চিপ ডিজাইন এবং টেস্টিং ও প্যাকেজিং খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

টাস্কফোর্স তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে ধারাবাহিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে: দক্ষতা উন্নয়ন, ব্যবসায়িক পরিবেশ ও নীতিগত সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব। স্বল্প , মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদে ধাপে ধাপে এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

২০২৫-২৬ সালের জন্য স্বল্পমেয়াদি সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে : একটি ভার্চুয়াল নলেজ পোর্টাল চালু করা, যেখানে বিশ্বমানের এবং শিল্প-সমর্থিত কারিকুলামের ভিত্তিতে স্তরভিত্তিক সার্টিফিকেশন প্রোগ্রাম থাকবে। ২০২৭ সালের মধ্যে অন্তত ৫টি সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিল্প-মানের প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন। প্রাথমিক পর্যায়ের চিপ প্যাকেজিং ও টেস্টিং যন্ত্রপাতি রাখার জন্য শেয়ার্ড, সহজসাধ্য এবং ভেন্ডর-নিউট্রাল ক্লিনরুম স্থাপন।

প্রকৌশলীদের জন্য রোটেশন-ভিত্তিক অন-সাইট প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা, যাতে ব্যবহারিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সার্টিফিকেশন ও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন। স্পষ্ট নীতিগত নির্দেশনা মেনে সীমিত সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পণ্যের আমদানি সহজিকরণ ও কর প্রণোদনা।

তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ বা বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে সেমিকন্ডাক্টর ফান্ড’ গঠন, যা নির্দিষ্ট মানদ-ের ভিত্তিতে নতুন উদ্যোগকে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বা টার্ম-ফাইন্যান্সিং সহায়তা দেবে।

দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশে নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশিদের (এনআরবি) বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণ খাতে সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া জ্ঞান স্থানান্তর ও কারিগরি সহযোগিতার জন্য সরকার-টু-সরকার (জিটুজি) পর্যায়ে কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলারও সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস টাস্কফোর্সের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে রোডম্যাপ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়।

চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ‘এই রোডম্যাপ বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক চিপ ডিজাইন ও টেস্টিং শিল্পে যুক্ত হওয়ার একটি স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত পথ দেখাচ্ছে। সঠিক উদ্যোগ নেওয়া গেলে এটি বাংলাদেশের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে।’

১৩ সদস্যের এই টাস্কফোর্সের মধ্যে রয়েছেন মো. আবদুর রহমান খান, শিশ হায়দার চৌধুরী, মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান, ইস্তাক আহমেদ, এম.এ. জব্বার, অধ্যাপক ড. এ. বি. এম. হারুন-উর-রশিদ, মেজর জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ, অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহফুজুল আজিজ, মাশুক রহমান, মোস্তাফিজ চৌধুরী, জহিরুল আলম এবং নাহিয়ান রহমান রোচি।

পরবর্তী ধাপে টাস্কফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের। বিশ্বব্যাপী কোম্পানিগুলো যখন তাদের সাপ্লাই চেইন বৈচিত্র্যময় করতে চাইছে, তখন দক্ষতা উন্নয়ন, নীতিগত সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেকে বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর অঙ্গনে প্রতিযোগিতামূলক ও বিশ্বাসযোগ্য এক উদীয়মান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।