নদীর দুঃখ, হারানো স্রোত ও পুনরুদ্ধারের প্রত্যয়—এসব হৃদয়ের আবেদন নিয়েই শনিবার দিনভর আয়োজন করা হয় নদী ও পরিবেশকর্মীদের মিলনমেলা। এই ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনের প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান।

ভোরের আলো ফুটতেই নদীপথে শুরু হয় নদীপ্রেমীদের যাত্রা। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাঞ্চন ঘাট থেকে একটি জাহাজে চড়ে তারা রওনা দেন গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার রাণীগঞ্জ এলাকার শীতলক্ষা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল ধাঁধার চরের উদ্দেশ্যে। নদীর বুকে এই যাত্রা পরিণত হয় পরিবেশ সচেতনতা, ভালোবাসা ও মানবিক সংযোগের এক অনন্য উৎসবে।

পথে পথে ছিল নদীর গল্প, আড্ডা, মতবিনিময়, গান ও মুক্তচিন্তার উচ্ছ্বাস। কেউ তুলেছিলেন নদীর ছবি, কেউ লিখেছেন কবিতা, কেউ আবার গেয়ে উঠেছেন নদী বাঁচানোর গান। নদীর চরে পৌঁছে চারপাশের সবুজ প্রকৃতি, জলরাশি আর নির্মল বাতাস যেন সবাইকে নবজীবনের আহ্বান জানায়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সেন্টমার্টিনে রাতযাপন নিষিদ্ধ করার পর অনেকেই অপপ্রচার চালিয়েছিল। কিন্তু এখন যারা যাচ্ছে, তারা বিস্মিত হচ্ছে প্রকৃতির পুনর্জন্ম দেখে। সেখানে কোরাল নতুন করে জন্ম নিচ্ছে, কেয়া বন ফিরে আসছে। আমরা দেখাতে পেরেছি, সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে প্রকৃতি নিজেই ফিরে আসে।

তিনি বলেন, শুধু প্রশাসন নয়, নাগরিককেও দায়িত্ব নিতে হবে। ফজরের পর যখন পাহারা থাকে না, তখন টুরিস্টরা ঢুকে পড়ে—এভাবে চলবে না। তাই আমরা টুরিস্ট পুলিশ নিয়োগ দিয়েছি। এটা চোর-পুলিশ খেলার বিষয় নয়, দায়িত্ববোধের প্রশ্ন।

পলিথিন বিরোধী অভিযানের প্রসঙ্গে উপদেষ্টা জানান, এখন সুপারমার্কেটে পলিথিন পাওয়া যাবে না। নিয়মিত অভিযান চলছে এবং বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের প্রচলন বাড়ানো হচ্ছে।

নদী দূষণ নিয়ন্ত্রণে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, নদী দূষণকারীদের একে একে ধরা নয়, বরং সবাইকে সেন্ট্রাল ইটিপির আওতায় আনা হবে। শিল্প মালিকদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও শিল্প দূষণ প্রতিরোধ একসাথে বাস্তবায়িত হলে তবেই আমরা পরিবেশ রক্ষা করতে পারব। তিনি আরও জানান, বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ঢাকার চারটি নদী পুনরুদ্ধারে একটি বড় প্রকল্প ডিসেম্বরের মধ্যে অনুমোদিত হতে যাচ্ছে, যেখানে পরিবেশ সুরক্ষায় আলাদা বরাদ্দ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও জনবান্ধব পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, চারজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে যতটুকু সম্ভব লড়াই করছি, কিন্তু কাজের পরিধি এতই বিশাল যে সম্মিলিত প্রচেষ্টাই একমাত্র সমাধান।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুইডেন এম্বাসির জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান, ফার্স্ট সেক্রেটারি নায়োকা মার্টিনেস বেক্সস্ট্রম; পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সোলায়মান হায়দার; পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোবাস্সির হোসেন; বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন; বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির এবং বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মনির হোসেন।

দিনভর চলা আয়োজনে নদী ও পরিবেশ বিষয়ক গান, কবিতা, আলোচনা ও মুক্ত মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণকারীরা এক কণ্ঠে উচ্চারণ করেন জীবনের আহ্বান—

“নদী বাঁচাও, জীবন বাঁচাও।”