অজানাকে জানা আর অসম্ভবকে সম্ভব করার তীব্র বাসনা থাকে মানুষের মধ্য। তবে সেই বাসনাটা কারও মধ্যে একটু বেশিই প্রবল। যার একটি বড় দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের আশিক চৌধুরী। পাখির মতো আকাশে উড়ে মেঘের ভাঁজে ঘুরে বেরিয়ে অনেক আগেই পরিচিতি পান পাইলট পরিবারের সন্তান আশিক।
পেশায় ব্যাংকার হলেও রপ্ত করেন বিমান চালানো। অন্তত অর্ধশত বার ঝাঁপ দেন হাজার ফুট উচ্চতার বিমান থেকে। অর্জন করেছেন স্কাইডাইভারের সার্টিফিকেটও। এর মধ্যে প্রায় ৪২ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ে যাওয়া বিমান থেকে শূন্যে লাফ দিয়ে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ঠাঁই করে করেন নেন নিজের নাম।
এত কিছু ছাপিয়ে নতুন করে অন্য কারণে আশিক চৌধুরীর নাম সামনে এসেছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত সেপ্টেম্বরে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান আশিক চৌধুরী। দায়িত্ব পাওয়ার পর কর্মদক্ষতা, উপস্থাপনা শৈলী ও যোগ্যতা নিয়ে মানুষের মন জয় করে ফেলেছেন ৪১ বছর বয়সী আশিক।

বুধবার (৯ এপ্রিল) বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তথ্যবহুল ও সাবলীল ভাষায় প্রেজেন্টেশন দিয়ে দেশের সম্ভাবনাময়ী খাতগুলো তুলে ধরেন তিনি। তার বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যেই তা ভাইরাল হয়। বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে দেশের প্রয়োজনে নিজেকে নানাভাবে উপস্থাপন করা আশিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ নেটিজেনরা। আশিক চৌধুরীকে নিয়ে জানার আগ্রহ বেড়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের।
প্রেজেন্টেশন সেই ভিডিও শেয়ার করে সোশ্যাল মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, ‘এই মেধাবী তরুণরা এত দিন দেশে আসতে ভয় পেতেন। কিন্তু ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর মেধাবীরা দেশে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই আশিক চৌধুরী। যিনি বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে দেশের প্রয়োজনে নিজেকে নানাভাবে উপস্থাপন করছেন।
লেখক গাজী মিজানুর রহমান তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কিছু লোক দেশপ্রেমের চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ভালো থাকার জন্য দেশের টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করে বিলিয়নেয়ার হয়, আর জনাব আশিক চৌধুরীর মতো কিছু লোক নিজ মাতৃভূমির ভালোবাসার টানে সিঙ্গাপুরের আয়েশি জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ছুটে এসেছেন দেশে। এখানে চেতনার ফেনা তোলা আর প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের মধ্যে মূল পার্থক্য।’ এভাবে অনেকেই আশিক চৌধুরীর প্রশংসা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।
কে এই আশিক
চাঁদপুরে জন্ম আশিক চৌধুরীর। তবে বাবার পোস্টিংয়ের কারণে শৈশব কাটে যশোরে। স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়েছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে অঞ্চলিক অফিসার হিসেবে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি কর্মজীবন শুরু করেন আশিক চৌধুরী। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে তিনি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে যোগ দেন এবং সেখানে ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত লেন্ডিং স্ট্র্যাটেজি এবং ফিন্যান্সিয়াল প্ল্যানিং বিভাগে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। তিনি দ্য বেঞ্চ নামে বাংলাদেশের প্রথম স্পোর্টস বার সহ-প্রতিষ্ঠা করেন।
২০১২ সালের অক্টোবরে মাসে আশিক লন্ডনে আমেরিকান এয়ারলাইন্সে ফিন্যান্সিয়াল ও স্ট্র্যাটেজিক এনালিস্ট হিসেবে যোগ দেন এবং মে ২০১৯-এ ইউরোপ ও এশিয়ার ফাইন্যান্স প্রধান হিসেবে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তিনি গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সিঙ্গাপুরে বহুজাতিক দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) রিয়েল অ্যাসেট ফাইন্যান্স বিভাগের সহযোগী পরিচালক ছিলেন। অফিস সিঙ্গাপুরে হলেও মাসের বড় একটা সময় কাটে বাংলাদেশ ও ভারতে। তিনি বাংলাদেশ ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে পেশাগত কৃতিত্বের জন্য অ্যাওয়ার্ড পান। ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের সহযোগী পরিচালক ছিলেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান আশিক। এছাড়াও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন। গত ৭ এপ্রিল তাকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়।
কর্মজীবনে বিভিন্ন ছুটির সময় ছুটে যেতেন রোমাঞ্চের টানে। ২০১১ সালে পড়তে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানেই ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম স্কাইডাইভিং করেন।আশিকের মাথায় স্কাইডাইভিংয়ের স্বপ্ন আসে মূলত পাইলট বাবার কাছ থেকে। শৈশব থেকেই তিনি মহাশূন্যে পাখির মতো ওড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
পেশাদার ব্যাংকার হওয়ার কারণে আশিক সিঙ্গাপুর ও ঢাকা দুই জায়গাতেই যাতায়াতের মধ্যে থাকেন। পেশাদার কাজের পর সময় পেলেই মেতে উঠেন আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ার খেলায়। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি প্রায় অর্ধশত বার আকাশ থেকে লাফ দিয়েছেন।
আশিক চৌধুরী যুক্তরাজ্যে এক বছর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর প্রাইভেট পাইলট হিসেবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হন। এরপর থাই স্কাই অ্যাডভেঞ্চার কোম্পানির অধীন স্কাইডাইভিংয়ের ওপর লম্বা প্রশিক্ষণ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। অর্জন করেন স্কাইডাইভারের লাইসেন্স। এই লাইসেন্স দেখিয়ে বিশ্বের যেকোনো দেশেই স্কাইডাইভিং করতে পারবেন আশিক।

গিনেস ওয়ার্ল্ডে রেকর্ড
উড়ন্ত বিমান থেকে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ঝাঁপ দেওয়ার প্রচেষ্টায় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখান আশিক চৌধুরী। গিনেসের ‘গ্রেটেস্ট ডিসট্যান্স ফ্রিফল উইথ আ ব্যানার/ফ্ল্যাগ’ শাখায় রেকর্ডটি ছিল ভারতের স্কাইডাইভার জিতিন বিজয়ানার। সে রেকর্ড গত বছরের জুলাই নিজের করে নেন আশিক। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস তাদের ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যে আশিকের তথ্য হালনাগাদ করেছে।
২০২৪ সালের ২১ মে রাতে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে উড়াল দেন আশিক চৌধুরী। এরপর এয়ারফিল্ডে দুই দিন অনুশীলন করেন। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় পূর্বনির্ধারিত সময়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়তে ৪১ হাজার ৭৯৫ ফুট উঁচুতে উড়ে যাওয়া বিমান থেকে শূন্যে লাফ দেন আশিক চৌধুরী। বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা দুই হাতে মেলে ধরে আকাশে ভাসতে থাকেন তিনি। চার হাজার ফুটের কাছাকাছি আসার পর প্যারাস্যুটের সাহায্যে মাটিতে নেমে আসেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসের উইংস ফিল্ড বিমানঘাঁটি থেকে বিমানে উড়ে এ প্রচেষ্টা চালান আশিক। সফলভাবে নেমে আসার পর আশিক চৌধুরী তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘কাজটা ঠিকঠাকভাবে করতে পেরে আমি খুব নির্ভার বোধ করছি। আশা করি দেশের জন্য বড় একটা রেকর্ড হবে।’