চীন বাদে যেসব দেশের ওপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল সেগুলো ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন ট্রাম্প। বাংলাদেশের ওপর গত সপ্তাহে পারস্পরিক শুল্ক হিসেবে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন তিনি। বুধবার তিনি এ ঘোষণা দেন। শুল্ক আরোপ স্থগিত করায় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড় শুল্ক স্থগিত করায় বেজায় খুশি ব্যবসায়িরা। এমন ঘোষণার ফলে রফতানি কারকরা স্বস্তির নি:শ^াস ফেলেছেন। তারা বলেছেন এসময়টা কাজে লাগাতে হবে সরকারের যাতে অদুর ভবিষ্যতে ব্যবসায়িরা কোন ধরনের ক্ষতির মধ্যে না পড়ে।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ইস্যুতে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চিঠিতে তিন মাসের জন্য শুল্ক স্থগিতের অনুরোধ করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। সে অনুরোধ রাখায় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রধান উপদেষ্টা লিখেছেন, “শুল্ক কার্যকর ৯০ দিন স্থগিত করার আমাদের অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আপনার বাণিজ্য এজেন্ডাকে সহায়তা করতে আমরা আপনার প্রশাসনের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখব।

এদিকে অন্য দেশগুলোকে ছাড় দিলেও চীনা পণ্যের ওপর মোট শুল্কের পরিমাণ ১০৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

নিজের মালিকানাধীন সামাজিক মাধ্যম ট্রুথে এ ব্যাপারে ট্রাম্প লিখেছেন, “বিশ্ববাজারের প্রতি চীন যে অসম্মান দেখিয়েছে, সেটির ভিত্তিতে আমি চীনের ওপর শুল্কের পরিমাণ ১২৫ শতাংশে উন্নীত করছি। যা এ মুহূর্ত থেকে কার্যকর হবে। একটা সময়ে, আশা করি দ্রুত চীন বুঝতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশকে ‘শোষন’ করার সময় বিষয়টি আর মানা হবে না। যোগ করেন তিনি।

অন্যান্য দেশগুলোর ওপর আরোপ করা পারস্পরিক শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করার বিষয়টি জানিয়ে ট্রাম্প লিখেছেন, “বিপরীতভাবে, ৭৫টিরও বেশি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের বাণিজ্য, বাণিজ্য বাধা, শুল্ক, মুদ্রা জালিয়াতি, অ-আর্থিক শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকেছে। এবং এই দেশগুলো আমার শক্তিশালী পরামর্শের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা ব্যবস্থা নেয়নি। তাদের জন্য আমি শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছি এবং পারস্পরিক শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। বিষয়টিতে মনযোগ দেওয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ।

গত এক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও নিজ নীতিকে সঠিক দাবি করে চলছিলেন। তার চাপিয়ে দেওয়া শুল্কনীতি বিশ্ববাজারে তোলপাড় সৃষ্টি করলেও তিনি ছিলেন অনড়। মঙ্গলবার রিপাবলিকানদের এক বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি জানি আমি কী করছি।’ এরপর বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লিখলেন, ‘ঠান্ডা মাথায় থাকো! সব ঠিক হয়ে যাবে। সেদিন সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে আরেকটি পোস্টে লেখেন, ‘এটা কেনার দারুণ সময়!’ অর্থাৎ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য উপযুক্ত মুহূর্ত বলেই তিনি মনে করছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত বাজারই তাঁকে নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে।

বিশেষ করে সরকারি বন্ডের সুদের হার হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। ফলে বুধবার বিকেলে ট্রাম্প বেশিরভাগ দেশের জন্য ৯০ দিনের জন্য ‘পারস্পরিক শুল্ক’ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন। প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ চারটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সাংবাদিকদের কাছে সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করলাম মানুষ একটু বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। সবাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, একটু বেশি চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।’

তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদেরও বড় ভূমিকা ছিল। অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সসহ হোয়াইট হাউসের সিনিয়র কর্মকর্তারা চাইছিলেন ট্রাম্প যেন একটি পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত কৌশলের পথে হাঁটেন। তারা চীনের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিতে চাইলেও অন্য দেশগুলোর সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছিলেন।

মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর অন্যান্য দেশের শুল্ক হার ও বাণিজ্য বাধার আনুমানিক হিসাব দিয়ে একটি ফর্মুলা তৈরি করেছিল, যাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তুলনামূলক ভারসাম্য রাখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট বেছে নেন একটি সহজ সূত্রযে দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি, তাদের ওপর বেশি শুল্ক।ফলে গত বুধবার যখন শুল্ক ঘোষণা করা হয়, তখনই বিশ্ববাজারে ব্যাপক ধস নামে।

ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা যতই অস্পষ্ট হোক না কেন, যে তিনি আগ্রাসী পদক্ষেপ নেবেন তা আদতে কারও কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না।

প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সময় থেকেই ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন একটি ‘ইউনিভার্সাল বেস লাইন ট্যারিফ’ চালুর। তার উপদেষ্টারাও তখন থেকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ট্রাম্প নিজের নীতিতে অটল থাকবেন।

প্রথম মেয়াদে তিনি মনে করতেন, উপদেষ্টারা তাকে বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে বিরত রেখেছিলেন। তাই দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি বলেছেন, এবার তিনি সবকিছু নিজের মতো করে করবেন। এ জন্যই নিজের চারপাশে সাজিয়ে নিয়েছেন এমন একটি টিম, যারা তার ‘ইনস্টিংক্ট’-এর (অনুমান বা ধারণা) প্রতি একেবারে বিশ্বস্ত।

ট্রাম্পের বক্তব্য, দশকের পর দশক ধরে বিদেশি দেশগুলো যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে শোষণ করেছে, তার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো শুল্ক। তিনি মনে করেন, এই পন্থায়ই দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করা যাবে। তবে বিনিয়োগকারী, ওয়াল স্ট্রিটের কর্তাব্যক্তি, এমনকি বড় বড় দাতা ও লবিস্টদের অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন, ট্রাম্প হয়ত হুমকি দিচ্ছেন মাত্র—বাস্তবে এতোটা এগোবেন না। অথবা কেউ হয়ত তাকে বোঝাতে সক্ষম হবেন।

এদিকে অভ্যন্তরীণ চাপে শুল্কনীতি থেকে পিছু হটলেন ট্রাম্প । বুধবার সকালে মার্কিন জনগণকে শেয়ার কেনার পরামর্শ দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একইসঙ্গে দেশি-বিদেশি কোম্পানিগুলোর উদ্দেশে আহ্বান জানান—তারা যেন তাদের কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করে।

কিন্তু সেই সময় কেউই আঁচ করতে পারেননি, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প তাঁর অবস্থান পাল্টে অধিকাংশ শুল্কের ওপর ৯০ দিনের বিরতি ঘোষণা করবেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তের পর শেয়ারবাজারে দ্রুত ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়, যা নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়—ট্রাম্পের সকালে দেওয়া শেয়ার কেনার আহ্বান কি তাহলে বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক ধরনের ‘সিগন্যাল’ ছিল?

শুল্ক নীতিতে হঠাৎ এই মোড় ঘোরানোর পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মাইক বসেন্ট ও হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি কারিন লেভিট। তাঁরা দাবি করেনএই সিদ্ধান্ত কোনো হঠাৎ পরিবর্তন নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত কৌশলের ফল। তাঁদের মতে, এর লক্ষ্য ছিল চীনকে আমেরিকান শ্রমিকদের কষ্টের মূল উৎস হিসেবে আলাদা করে চিহ্নিত করা।বসেন্ট বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাই তো শুরু থেকেই ছিল।’

প্রেস সেক্রেটারি লেভিট নীতিগত এই ইউ-টার্নকে ‘আর্ট অব দ্য ডিল’ বলে উল্লেখ করেন। ‘আপনারা অনেকেই ট্রাম্পের কৌশল বুঝতে পারেননি,’ বলেন লেভিট। ‘আপনারা বলেছিলেন, বাকি দুনিয়া চীনের দিকে ঝুঁকবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো।

ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টা স্টিফেন মিলার এক ধাপ এগিয়ে এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন: ‘আপনারা আমেরিকার ইতিহাসে কোনো প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে কৌশলী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করলেন। বসেন্ট আরও বলেন, ৯০ দিনের বিরতির সিদ্ধান্ত একান্তভাবেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিজের। তার দাবি, শেয়ারবাজারে ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেছেন, ‘এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ট্রাম্প অসাধারণ সাহস দেখিয়েছেন। আমরা বিশ্বের সব দেশকে বলেছি—আপনারা পাল্টা ব্যবস্থা না নিলে পুরস্কার পাবেন। যারা আলোচনায় আসতে চায়, আমরা তাদের কথা শুনতে প্রস্তুত।’

এদিকে শুল্ক স্থগিত করায় ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনি লিখেছেন, ‘শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের বিষয়ে আমাদের আহ্বানে সদয় সাড়া দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনার বাণিজ্যিক কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়ে আমরা আপনার প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্র শুল্কে সাময়িক স্থগিতাদেশ দেয়ায় আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, এই সময়ে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর নানা পদক্ষেপ নিতে পারব। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক তিন মাস স্থগিত করায় তা তাৎক্ষণিক সুরক্ষা দেবে। এতে আলোচনার সময় আরও পাচ্ছি। সাময়িক স্থগিতাদেশ দিয়েছে, তাই নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর নানা পদক্ষেপ নিতে পারব।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘এই বিরতি বাংলাদেশকে প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় দিচ্ছে। তার মতে, ‘চীন শুল্কের মুখে পড়ায় আগামী ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারে।’

বিকেএমই এর একজন পরিচালক বলেন, দীর্ঘমেয়াদে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আগামী ৯০ দিনে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কতটা কার্যকরভাবে দরকষাকষি করতে পারছে এর ওপর।

নীট শিল্প মালিক মজিবর রহমান বলেন, ‘সরকারের উচিত মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবিড় আলোচনা শুরু করা। যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কায় এক বিদেশি ক্রেতা আগের কার্যাদেশ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছেন।