দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একসময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে বিবেচিত আওয়ামী লীগ এখন দেশের মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে। বিগত ১৬ বছর ধরে দেশে অপশাসন চালিয়েছে শেখ হাসিনা এমন অভিযোগ রাজনৈতিক মহলে। বিশেষ করে গুম খুন, হত্যাসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে বর্তমানে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে আর মানুষ গ্রহণ করছে না।

এরই মধ্যে গত বছর ছাত্র জনতার গণঅভুত্থ্যানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। একই সাথে পালিয়ে যায় দীর্ঘ দিন ধরে আওয়ামী লীগের পরিচয়ে অপকর্ম করা অনেক নেতা। এসব নেতাদের বিচারের জন্য গঠিত হয় ট্রাইব্যুনাল। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।

এরই মধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন (এলজিআরডি) ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকার শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে।

আসিফ মাহমুদ বলেন, প্রথমত এটা অত্যন্ত ইতিবাচক যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একধরনের ‘ঐকমত্য’ তৈরি হচ্ছে। দেশের মানুষ তৎকালীন ক্ষমতাসীন ওই দলের অগণতান্ত্রিক এবং একগুঁয়েমি মনোভাব ও কার্যকলাপ মেনে নিতে পারেনি বলেই ৫ আগস্টের আগে ও পরে তাদের মধ্যে দলটি নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন ঐকমত্য তৈরি হলে সরকারের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।

জানা গেছে, বর্তমানে জনসমর্থনের তীব্র সংকটে পড়েছে আওয়ামী লীগ। দলটিকে শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজের প্রত্যাখ্যান, বিশেষ করে গত বছরের গণআন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী তরুণদের ক্ষোভ, এর ভবিষ্যৎকে আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ভাঙচুর এই বার্তাই বহন করে যে, আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য ও তাদের শাসননীতি জনগণের একটি বড় অংশের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি ও দলটির প্রতি জনমনে সঞ্চিত ক্ষোভ কিভাবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, তা এখন সময়ের অপেক্ষা।

সূত্র জানায়, গুম খুন, হত্যাসহ নানা নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণে বর্তমানে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বৈধতার সঙ্কটে পড়েছে। ২৪’র জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন গণহত্যার মতো মারাত্মক অপরাধের দায় দলটির মাথার ওপরে। রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বেশির ভাগের দাবি- গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক। এদিকে এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে পথ বাতলানোর পরিবর্তে বিদেশে বসে এবং আত্মগোপনে থেকে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলার নানা ছক কষছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে. বুধবার সন্ধ্যায় ভারতে নির্বাসিত শেখ হাসিনা অনলাইনে তার সমর্থকদের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে একটি উত্তপ্ত বক্তৃতা দেন। এর পরপরই জনতা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জড়ো হয় এবং তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনের পাশাপাশি বিক্ষোভকারীরা আওয়ামী লীগের নির্বাসিত নেতাদের বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেয়।

বিশ্লেষকরা বলেন, শেখ মুজিবের বাসভবন ভাঙচুরের ঘটনা জনগণের একটি অংশের, বিশেষ করে গত বছরের গণ-বিক্ষোভের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র ও তরুণদের, দলের ঐতিহ্যের প্রতি তীব্র প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত দেয়।

জোবান ম্যাগাজিনের বিশ্লেষক ও সম্পাদক রেজাউল করিম রনি বলেন, ‘৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই বাড়িটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আংশিক ভাঙচুর সত্ত্বেও এটি বেশিভাগ ক্ষেত্রেই অক্ষত ছিল। এখন শেখ হাসিনা বিদ্রোহ অস্বীকার করছেন এবং গণহত্যার জন্য কোনো অনুশোচনা দেখাচ্ছেন না। বরং তার সমর্থকদের উসকে দিচ্ছেন। তাই জনগণ যা অবশিষ্ট ছিল তা শেষ করে এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের অনেকেই এ পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন। কিন্তু তাদের বোঝা উচিত যে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল এবং হাসিনার সময়ে তা চরমে পৌঁছেছিল। জুলাইয়ের বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে আওয়ামী লীগের এই গোষ্ঠীগত, পেশী-ভিত্তিক রাজনীতি আর টিকে থাকবে না। আওয়ামী লীগের কোনো ভবিষ্যৎ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। ’তাদের কলঙ্কিত পতনের পর নেতৃত্বের পরিবর্তনও আওয়ামী লীগকে আর জনপ্রিয় করতে পারবে না।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বিদেশী একটি গনমাধ্যমকে বলেন, ‘শুধু তো আমাদের দলীয় নেতাকর্মী নন, এমন বহু মানুষÑ যারা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, প্রগতিশীল ভাবনায় বিশ্বাসী তাদেরকেও তো মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে। আমাদের নেতাদের কথা তো ছেড়েই দিন, কত যে মিথ্যা মামলা দিয়েছে আমাদের নামে, এখন আর তার খোঁজও রাখি না আমরা। দলের কর্মীরা যারা দেশে আছেন, তাদের তো আওয়ামী লীগ পরিচয় দেওয়ারও অধিকার কেড়ে নিয়েছে

ধানমন্ডি ৩২ এ শেখ মুজিবের বাড়ি ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে সম্প্রতি হামলা ভাঙচুর আওয়ামী লীগের শাসনামলে হওয়া হত্যা, গুম, খুন, নির্যাতনের পরিণতি হিসেবেই দেখছেন দলটির সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ।

ফেসবুক পোস্টে সোহেল তাজ লিখেছেন, ‘কী নির্মম পরিণতি ১৫ বছরের হত্যা, গুম, খুন, নির্যাতন, নিপীড়ন, গণতন্ত্র ধ্বংস, ভোটাধিকার হরণ, দুর্নীতি, লুটপাট, লাখ লাখ কোটি টাকা পাচারের। জুলাই-অগাস্ট গণহত্যা করে আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা, অনুশোচনা না করে, হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু করে, শত শত মানুষকে অন্ধ করে ক্ষমা না চেয়ে আবার বিদেশে বসে এখন আন্দোলনের ডাক দিলে আর কী পরিণতি হতে পারে!’

রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম সাংবাদিকদের বলেন, ২৪’র জুলাই গণহত্যাকারী দল হলো আওয়ামী লীগ। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। ফলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার আর কোনো বৈধতা নেই, নৈতিক ভিত্তিও নেই। তিনি বলেন, আইনগতভাবে এখনো বৈধতা থাকলেও দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে আর এ দেশে রাজনীতি করতে দেবে না।

অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান মনে করেন, আওয়ামী লীগ তাদের রাজনীতি করার নৈতিক বৈধতা হারিয়েছে। বাকশাল গঠনের আগে আওয়ামী লীগ যেমন নিজেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিল, তেমনি এখন তারা আবার দ্বিতীয়বার আত্মবিলুপ্তির পথে হাঁটছে। যেভাবে মুসলিম লীগ বিলুপ্ত হয়েছে, একইভাবে আওয়ামী লীগও একদিন বিলুপ্ত হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, বাংলাদেশের মানুষ গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের বিতাড়ন করেছে। বাংলাদেশে সেই আওয়ামী লীগের নামে কেউ রাজনীতি করতে পারবে না। দলটির গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তাদের বিচার দাবি জানাচ্ছি।