সেন্টার ফর সিভিল সোসাইটি আয়োজিত ‘গণভোট না অর্ডিনেন্স-প্রসঙ্গ জুলাই সনদ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, আইনজীবীরা বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দীর্ঘ এক বছর পর জুলাই ঘোষণাপত্র দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কার করা সংবিধানের তফসিলে এই ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। জুলাই সনদকে সংবিধানের ৪র্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটি জুলাই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হয়ে। কারণ এটি একটি হিস্ট্রিক্যাল এভিডেন্স। এই ঘোষণাপত্র তফসিলে সন্নিবেশিত করতে হলে সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে। জনআকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন করতে হলে ১৫০ নম্বর অনুচ্ছেদকে পঞ্চদশ সংশোধনী আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হবে অথবা সংবিধানের ১৫০ নম্বর অনুচ্ছেদ নতুন করে লিখতে হবে। ১৫০ নম্বর অনুচ্ছেদ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে আজকের ঘোষণাপত্রটি চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলবে। একই সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা ও পরবর্তী সরকার গঠন পর্যন্ত তাদের কাজের বৈধতাও এই ১৫০ নম্বর অনুচ্ছেদ ও চতুর্থ তফসিলের মাধ্যমে হতে হবে। এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে সেটা সংবিধান সংশোধন করে যুক্ত করতে হবে। ঘোষণাপত্রের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে ভবিষ্যতে সাংবিধানিকভাবে এর স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে এবং সুনির্দিষ্টভাবে সংস্কার করা সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে তারা এইসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সেন্টার ফর সিভিল সোসাইটির সভাপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর আইনজীবী মো: পারভেজ হোসেন। সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের আইনজীবী ও বাংলাদেশ সরকারের অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নী জেনারেল হুমায়ুন কবির তানিমের সঞ্চালনায় এসময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এফ এম আব্দুর রহমান। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ইসলামী ছাত্র শিবির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর সিনিয়র এডভোকেট ব্যারিস্টার ইমরান আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. আব্দুল্লাহিল আমান আযমী, ইনকিলাব মঞ্চের আহবায়ক শরিফ ওসমান হাদী, ব্যারিস্টার সাজ্জাদ আলী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের নায়েবে আমীর এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, ব্যারিস্টার শারমিন জাহান মিলি, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো: রাশেদ খানসহ অনুষ্ঠানে সমাজের সচেতনমহল ও সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। গোলটেবিল আলোচনায় নোট স্পিকার বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের আইনজীবী ব্যারিস্টার এস এম শাহরিয়ার কবির।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এফ এম আব্দুর রহমান বলেন, এসময় তিনি এত প্রাণহানীর বিনিময়েও জুলাই আন্দোলনকে বিপ্লবে পরিনত না করতে পারায় দুঃখ প্রকাশ করেন। একইসাথে জুলাই ঘোষণাপত্রে সকল রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করার মাধ্যমে জুলাই সনদের কাজ শুরুর আহবান জানান। তিনি বলেন এই জুলাই সনদকে সংবিধানের ৪র্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা সদিচ্ছা এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই জরুরি। আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা থাকলে কিভাবে এই সনদকে শহীদ আহত এবং জনসাধারণের পক্ষে একটি সাংবিধানিক বিধিবদ্ধ হিসেবে তৈরি করা যায় তার পথ বের হয়ে যাবে।
ইসলামী ছাত্র শিবির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন-এই সরকার এতগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেছে আমরা দেখেছি। অথচ এই জুলাই বিপ্লব যে সংগঠিত হয়েছে তা মূলত হয়েছে ক্যাম্পাসভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে এবং ছাত্রদের দ্বারা অথচ ছাত্রদের মনস্তাত্ত্বিক এবং একাডেমিক ডেভলপমেন্টর জন্য সরকার কোন কমিশন গঠন করেনি। তিনি বলেন আমরা মনে করি ফ্যাসিবাদ কায়েম হওয়ার কোন সুযোগ রাখা যাবে না তাই জুলাই সনদের পক্ষে গণভোট হওয়া জরুরি।
গুমের শিকার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, যত সরকার এসেছে তারা তাদের নিজেদের ও নিজেদের দলের আখের গুছিয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় আমরা পৈশাচিক হয়েছি। নানান সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমরা আস্থা রাখতে পারিনি। তাই জুলাই সনদের যদি আইনগত বৈধতা না থাকে তাহলে নির্বাচিত সরকার এই সনদকে নাও মূল্যায়ন করতে পারে।
ইনকিলাব মঞ্চের আহবায়ক শরিফ ওসমান হাদী বলেন, আমরা আগেই বলেছিলাম যে এই জুলাই সনদের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল হতে হবে। যেহেতু এই সরকার জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মেন্ডেট নিয়ে বসেছে তাই উচিত ছিল জুলাই শহীদদের সাথে এবং আহতদের সাথে লম্বা সময় নিয়ে কথা বলে জুলাই সনদ প্রস্তুত করা। কিন্তু এই সরকার কি করলো জুলাই সনদ প্রস্তুতির সময় তারা রাজনৈতিক দলের সাথে চা, পানি সিঙ্গারা, সমুচা খেতে খেতে জুলাই সনদ ঠিক করলেন।
গোলটেবিল আলোচনায় কি-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের আইনজীবী ব্যারিস্টার এস এম শাহরিয়ার কবির তিনি বলেন স্বাধীনতার পর হতে এ দেশের মানুষ ক্রমাগত প্রতারিত হচ্ছে। যখন যে দলই ক্ষমতায় গিয়েছে তারা ক্ষমতায় গিয়ে দলীয় স্বার্থ ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কিছুই করেনি। তাই জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি যদি মজবুত না হয় তাহলে পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার এলে আরেকবার এ দেশের মানুষ প্রতারিত হতে পারে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর সিনিয়র এডভোকেট ব্যারিস্টার ইমরান আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, আমাদেরকে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি, বৈধতা এবং জনসমর্থন নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যারিস্টার সাজ্জাদ আলী তিনি মিশর ও শ্রীলংকার অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের উদাহরণ টেনে বলেন, সাধারণত দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের কথা বললেও যখন তারা ক্ষমতায় যায় তখন রাজতন্ত্রের দিকেই ধাপিত হয়। তাই জুলাই সনদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য এবং এই সনদের আইনগত ভিত্তি প্রদান করা জরুরি
এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, জুলাই সনদকে নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে। ৫ ই আগস্ট যে ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছে তা মূলত জুলাই সনদ নয় বরং জুলাই ঘোষণাপত্র। জুলাই সনদে জুলাই বিপ্লবের যারা স্টেক হোল্ডার তাদের বিষয়টি যথাযথভাবে তদারকি করার এবং গণভোটে আয়োজন করার মাধ্যমে সংবিধানে জুলাই সনদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের সমালোচনা নয় বরং সম্মিলিত ঐক্যের মাধ্যমে জুলাই সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
ব্যারিস্টার শারমিন জাহান মিলি বলেন, গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হচ্ছে একই প্লাটফর্মে থেকে ভিন্নমত পোষণ করা। আমি মনে করি যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত আছে তাই জুলাই সনদের জন্য গণভোট নয় রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছায় যথেষ্ট। অর্ডিন্যান্স এর মাধ্যমেও এই সনদকে আইনগত বৈধতা দেওয়া যায়।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো: রাশেদ খান বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তার একটি ভাষণে বলেছেন মানুষ গণভোট বোঝেনা। তার বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে তিনি গণভোটের আয়োজন করতে রাজি নয়। তবে আমরা দাবি তুলতে পারি। এর গুরুত্ব তুলে ধরতে পারি।