জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নে গণভোট দিতে দেরি হওয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরকে নিয়ে আক্রমণাত্বক বক্তব্য দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, গণভোট নিয়ে অস্থিরতা বাড়তে থাকলে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে যত তাড়াতাড়ি এব্যাপারে স্পষ্ট পদক্ষেপ নিবে তত তাড়াতাড়ি অস্থিরতা কমে আসবে। স্থিতিশীল হবে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের প্রতিবেদনে প্রস্তাব করেছে, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে অথবা নির্বাচনের দিনেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দল বলছে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট জুলাই সনদকে আইনি বৈধতা দিয়ে এরপর জুলাই সনদের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন হউক। অপরপক্ষে বিএনপি বলছে নির্বাচনের দিনেই Ñ দুটি আলাদা ব্যালটে ভোট অনুষ্ঠিত হোক।

মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর থেকে-ই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দল বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গত ৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর আহ্বান করা হয়। কিন্তু দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। প্রকাশ্যে তারা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলেছেন নির্বাচনের দিনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান তার দল কখনোই মানবে না। সময়স্বল্পতা ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগসহ একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো বিশাল আয়োজন বিবেচনায়Ñনির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে ও একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনাদলগুলো গণভোটের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। তারা চায় নভেম্বরের মধ্যেই গণভোট হোক। নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে থাকা এনসিপি-ও একই দাবি জানিয়ে বলেছে, জুলাই সনদ কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দেশে কোনো নির্বাচন হতে পারে না।

আগামী ১৬ নভেম্বরের মধ্যে পাঁচ দফা দাবি না মানলে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতসহ সমমনা ৮ দল। দলগুলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির শীর্ষ নেতারা এবিষয়ে যৌথ সাংবাদিক সম্মলন করে কর্মসূচি ঘোষণা করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ ও গণভোটের বিষয়টি নতুন করে রাজনৈতিক বিভাজন, অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। জনগণের মধ্যেও সন্দেহ বাড়ছেÑনির্বাচন আদৌ হবে কিনা, আর হলেও তা বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না। একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হলে তার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে ব্যবসা ও নাগরিক জীবনে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল বুধবার সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ৮৪টি সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়েছে। কমিশন প্রধান উপদেষ্টার নিকট জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা জমা দিয়েছে। আমরা মনে করি, গণভোট ব্যতীত জুলাই জাতীয় সনদ আইনগত টেকসই ভিত্তি পাবে না। তাই নভেম্বর মাসের মধ্যেই গণভোট সম্পন্ন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও স্বৈরাচার ফিরে আসার সকল পথ রুদ্ধ করার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপও নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ভয়ভীতিমুক্ত নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি।

মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ২-৩ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাবে সরকার। তিনি বলেন, ‘সব দলের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছি। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, ভালো কিছু হবে। আশা করি, সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত সব দল মেনে নেবে। আরেক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকারের অবস্থানটা সরকার স্পষ্ট করেছে। অনেকগুলো ক্ষেত্রেই তো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়নি সেগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে নিজেরা একসঙ্গে বসে একটা ঐকমত্যে এসে সরকারকে জানায়। আমরা জেনেছি, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সেই প্রক্রিয়া যায়নি। আমরা বলেছিলাম রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেরা সমাধান করতে না পারে তবে সরকার অবস্থান নেবে। যেহেতু সাত দিন পার হয়ে গেছে, এখন সরকার বসবে। সরকার অভ্যন্তরীণ ভাবে আলোচনা করে যেটা ভালো মনে হয় সরকার সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার আগে উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা। আশা করা হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বক্তব্য পরিষ্কার করবেন। বলা হচ্ছে, এই একটি তারিখ ঘোষনা উদ্বুত রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে যাবে।