ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) দেশের গনমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে এবং এর থেকে ভবিষ্যত বাংলাদেশ কী ধরনের শিক্ষা নিতে পারে, তা নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ও ক্লুনি ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিস।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) সকালে ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেলে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠান ও প্যানেল আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে ৩৯৬ জন সাংবাদিক সংশ্লিষ্ট ২২২টি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে ডিএসএ কীভাবে সাংবাদিকতা ও সমালোচনাকে শাস্তিযোগ্য করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া, ডিএসএ’র প্রয়োগ ও এর প্রভাব সম্পর্কে সরাসরি জানতে ৩০ জন সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতাসীনরা ডিএসএ কে সাংবাদিকদের হয়রানি ও ভয় দেখানোর হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। বিশেষত রাজনীতিবিদরা (২২২টির মধ্যে ৭৩টি মামলা) ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের উদ্দেশ্যে আইনটি ব্যবহার করেছেন। অনেক সাংবাদিককে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগকারী ঘটনার প্রকৃত ভুক্তভোগী হোক বা না হোক, এ আইনটি যে কাউকে অভিযোগ করার সুযোগ দিয়েছিল। ফলে, একই ব্যক্তিকে একই ঘটনার জন্য একাধিক মামলারও শিকার হতে হয়েছিল।

একটি মামলার উদাহরণে দেখা যায়, পুলিশের দুর্নীতির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মামলা না করলেও শাসক দলের একজন সংক্ষুব্দ ব্যক্তি সেই গনমাধ্যম কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। ঐ সাংবাদিক জানান, জিজ্ঞাসাবাদের সময় পাঁচ থেকে ছয়জন কর্মকর্তা তাকে আক্রমণাত্মকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার অভিযোগও তিনি করেন। জিজ্ঞাসাবাদের প্রধান বিষয় ছিল তিনি “সরকারবিরোধী” মনোভাব পোষণ করেন কি না।

প্রতিবেদনের উপর হওয়া প্যানেল আলোচনায় আলোচক হিসেবে ছিলেন, মোঃ আসাদুজ্জামান, অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ; সারা হোসেন, ব্যারিস্টার ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), মানেকা খান্না, সিনিয়র লিগ্যাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ক্লুনি ফাউন্ডেশন ফর জাস্টিস, ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করেছেন সিজিএস’র গবেষণা সহযোগী রোমান উদ্দিন।

আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘সাংবাদিক নির্যাতনের জন্য রাষ্ট্র অনেক রকম পথ খোলা রেখেছে। যেটা বলা হয় আকাশের যত তারা, আইনের তত ধারা। সাংবাদিকদেরকে নির্যাতনের ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আকাশের সব রকম তারার মতো আইনের ধারা প্রয়োগ করা হয়।’

শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না বলে মনে করেন আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এই ট্রেন্ডটাকে পরিবর্তন করতে হলে রাষ্ট্রের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।

আসাদুজ্জামান আশা প্রকাশ করেন, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইনের পথ থেকে ফিরে আসবে। তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নীতিতে ফিরে যাবে না। ডিএসএ’র বেশিরভাগ মামলাই বিচারপর্যায়ে পৌঁছায়নি। যেগুলো বিচার পর্যন্ত গেছে, সেগুলোর মধ্যে সাংবাদিকদের অধিকাংশই খালাস পেয়েছেন (ডেটাসেটে মাত্র একজন সাংবাদিক দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন)। এটি ডিএসএ মামলাগুলোর ভিত্তিহীনতা স্পষ্ট করে। তবে মামলা পরিচালনার দীর্ঘ প্রক্রিয়া সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত, পেশাগত ও আর্থিক জীবনে গুরুতর ক্ষতি করেছে এবং সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছিল, তা কখনোই বিচার শেষ করার জন্য ছিল না; বরং কথা বলা বন্ধ করার জন্য, লেখা বন্ধ করার জন্য করা হয়েছিল।

এখন আইনি কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে সারা হোসেন বলেন, ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের গাইডলাইন এখন সিআরপিসি সংশোধনীতে যুক্ত হয়েছে। এটা বড় অগ্রগতি; কিন্তু বাস্তবায়ন এখনো দুর্বল।

প্রেস কাউন্সিল যথাযথভাবে কাজ করছে না বলে মন্তব্য করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, তাই গণমাধ্যম কমিশনের যে সুপারিশ এসেছে, তা ভালো। পাশাপাশি এই মুহূর্তে মানবাধিকার ও তথ্য কমিশনকে সক্রিয় করা প্রয়োজন, যাতে সবকিছু আদালতে না গিয়ে এসব কমিশনে সমাধান আসে।

আগ্রহীরা সিজিএস’র অফিস থেকে প্রতিবেদনটি সংগ্রহ করতে পারবেন। এছাড়া, সিজিএস ও ক্লুনি ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটেও প্রতিবেদনটি পাওয়া যাবে। পাশাপাশি, প্রতিবেদনের ডেটা এনালাইসিস ও ডেটা ভিজ্যুয়াল দেখতে পাবেন এ ওয়েবসাইটে - https://cfj.org/bangladesh-journalists/