বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের চারদিনের চীন সফরে উল্লেখ করার মতো অর্জন হয়েছে বাংলাদেশের। বিনিয়োগ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, সমন্বিত পানি ব্যবস্তাপনাসহ বেশকিছু অর্জন বাংলাদেশের স্বার্থকে সামনে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে উৎপাদনমুখী কারাখানা স্থানান্তর বাংলাদেশের কর্মসংস্থানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের কাছ থেকে বিশাল অংকের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। একইসঙ্গে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নেও মিলেছে প্রতিশ্রুতি। এই সফরের মধ্যে দিয়ে দেশে চীনা বিনিয়োগ আরও বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার সফরের মধ্যে দিয়ে ২০২৮ সাল পর্যন্ত চীনে কোটা ও শুল্ক সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস সফরকালে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে দ্বি-পক্ষীয় সহযোগিতা বাড়াতে ঐকমত্য পোষণ করেছেন উভয় দেশের শীর্ষ নেতা। একইসঙ্গে ‘এক চীন নীতি’তে বাংলাদেশ তার অবস্থান আবারও স্পষ্ট করেছে চীনের কাছে। ফলে চীনের পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে সেদেশের সরকার ও চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে দেশটির প্রায় ৩০টি কোম্পানি বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। এ ছাড়া মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে চীন। চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরও ১৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। অনুদান ও অন্যান্য ঋণ সহায়তা হিসেবে আসবে বাকি অর্থ।
২০২৮ সাল পর্যন্ত চীনে কোটা ও শুল্ক সুবিধা
বাংলাদেশের বিদ্যমান শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা আরও দুই বছর বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে চীন। এর আগে চীনা বাজারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য এই সুবিধা ছিল। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চীনা উপ প্রধানমন্ত্রী ডিং জুংশিংায়ের এক বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে চীনা উপ প্রধানমন্ত্রী এ ঘোষণা দেন চীনের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ২০২৮ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
কম খরচে স্বাস্থ্যসেবার দুয়ার খুললো
এদিকে চীনে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে কুনমিং ফ্লাইট পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনস। গতকাল শনিবার একথা জানায় কর্মকর্তারা। ফলে দক্ষিণ চীনের সিটিতে অবস্থিত হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্য সেবা পাবে বাংলাদেশের মানুষ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য কুনমিংয়ের ৪টি হাসপাতাল বরাদ্দ রাখবে। কিন্তু তাতে দেখা যায় অতিরিক্ত বিমান ভাড়ার কারণে রোগীদের জটিলতায় পরতে হয়। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন কুনমিং টু চট্টগ্রাম ফ্লাইট চালূ হলে বিমান ভাড়া এবং ভ্রমনের সময় কমে আসবে। ফলে বাংলাদেশের মানুষ চীনের স্বাস্থ্য সেবা নিতে পারবে স্বাচ্ছন্দে। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাজমুল ইসলাম বলেন কনবিং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের মানুষের জন্য হাসপাতলের ফ্লোর উৎসর্গ করেছেন। একইসাথে চিকিৎসা খরচও কমানো হয়েছে। চীনের স্থানীয় মানুষ যে খরচে চিকিৎসা পায় একই খরচে চিকিৎসা পাবে বাংলাদেশের মানুষ। কুনমিং ভ্রমণ ত্বরান্বিত করার জন্য, ঢাকার সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষও ঢাকা এবং কুনমিং এর মধ্যে ফ্লাইটের বিমান টিকিটের মূল্য কমিয়েছে। চায়না কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বাস্ত্যসেবা বাড়ানোর জন্য আরও বেশি সুবিধা বৃদ্দি করবে। প্রসঙ্গত আগামী মাসে (এপ্রিলে) বাংলাদেশ থেকে একদল সাংবাদিক যাবে সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা পর্যবেক্ষণের জন্য। এর আগে গত মাসে একদল বাংলাদেশী প্রথমবারের মতো কুনমিং গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, সেখানে স্বাস্ত্যসেবা খুবই উন্নত। তবে ভ্রমণ খরচ অত্যাধিক বলে জানিয়েছেন তারা।
চীনে আম রপ্তানির দুয়ার খুলল
চীন বাংলাদেশ থেকে আম নিতে আগ্রহী। বাংলাদেশও চীনে আম পাঠাতে চায়। বাংলাদেশ চীনে আম রপ্তানির জন্য ৬ বছর আগে দেশটির কাছে আবেদন করেছিল। তবে নানা জটিলতায় সেটা আর কার্যকর হয়নি। তবে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের মধ্যে দিয়ে সেদেশে আম রপ্তানির দুয়ার খুলেছে। আগামী মে-জুন মাস থেকে চীনে আম রপ্তানি শুরু হবে। এর মধ্যে দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশি আমের চাহিদা বাড়বে।
তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা দেবে চীন
তিস্তা নদী প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক আগেই থেকে চীনের সহায়তা চেয়ে আসছে বাংলাদেশ। এবার প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে এই প্রকল্পে সহায়তার আশ্বাস মিলেছে। তবে শুধু তিস্তা প্রকল্প নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি অধ্যাপক ইউনূস। তিনি নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক চীন সফরে সেদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী লি গোইয়িংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেসময় নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। বৈঠকে তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও ঢাকার চারপাশের দূষিত পানি পরিষ্কারের বিষয়ে সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন ড. ইউনূস।
এক চীন নীতিতে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি
বাংলাদেশ সবসময় এক চীন নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেও মনে করে বাংলাদেশ। তবে
এবার প্রধান উপদেষ্টার সফরে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে। একইসঙ্গে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তার ব্যাপারে নিজেদের অঙ্গীকারের কথা স্পষ্ট করেছে। এ ছাড়া অন্তর্র্বতী সরকারের পথচলায় সমর্থনের কথাও বলেছে চীন।
তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়ে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেছেন, এই বাক্যটি হয়তো চীনের আগ্রহে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হোক বা না হোক, এটি কোনো পার্থক্য তৈরি করে না।
৯ চুক্তি ও সমঝোতা সই
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে একটি চুক্তি ও ৮টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতা–সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে সই হয়েছে ৮টি সমঝোতা স্মারক। উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বুধবার চারদিনের চীন সফরে যান। প্রধান উপদেষ্টার এটাই প্রথম কোনো দেশে দ্বি-পক্ষীয় সফর।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী মন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট শিজিনপিংয়ের প্রধান প্রটোকল অফিসার হংলি প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাত করেছেন। বেইজিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের এই সাক্ষাত হয়। এরই মধ্য দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার চার দিনের ঐতিহাসিক সফর শেষ হয়। গতকাল শনিবার রাতে তিনি ঢাকায় ফিরেন।