আজ ৭ জুলাই সোমবার পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৭ জুলাই বাংলা অবরোধে শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে অবরোধ কর্মসূচি পালন হয়। অহিংস এই আন্দোলনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা মহানগরী। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সারাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষার্থীরা।

জুলাই আগস্টের আন্দোলনটাকে কয়েক ধাপে ভাগ করা যায়। প্রথম ধাপটা শুরু হয় জুন মাসে। ওই আন্দোলনের মাঝে একটা ঈদ হয়। ঈদের পর অনেকেই ভেবেছিল আন্দোলনটা আর দাঁড়াবে না। এর মধ্যেও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নেতৃ স্থানীয়রা দ্বিতীয় ধাপের জন্য জন্য প্রস্তুতি নেয়। ঈদের পর যখন দ্বিতীয় ধাপের আন্দোলন শুরু হলো তখন ছাত্রলীগের হামলা আর নির্যাতন বেড়ে যায়। এজন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে টানা বেশ কঠিন হয়ে পরে। কারণ বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরাই হলে থাকে, হলের শিক্ষার্থীদের নিয়েই মূল আন্দোলনটা চালিয়ে নেয়া হচ্ছিল। ছাত্রলীগ মনে করেছিল শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন করা হলে ভয় পেয়ে ছাত্রছাত্রীরা আর বের হবে না। আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। তৃতীয় ধাপে এসে সরকার খুন খারাবি শুরু করে।

এদিন রাজধানী ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা, খুলনা, রংপুর, সাভার, সিলেট, দিনাপজুর গাজীপুরসহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাগুলো উত্তাল হয়ে উঠে। বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে সারা দিন অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। পরের দিন সোমবার (৮ জুলাই) এ কর্মসূচি চলবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়।

ওই সময়টাতে সাংবাদিকতা ছিল হাসিনার চাটুকারিতা। সরকারের নূন্যতম সমালোচনা করলে তা সহ্য করা হতো না। ন্যূনতম কেউ সাংবাদিকতার করতে চাইলে জেলের কথা সব সময় ভাবতে হতো। আর হাসিনার সরকারের প্রসংশা করলে মিলতো পুরষষ্কার। কেউ একটু কঠিন করে প্রশ্ন করার চেষ্টা করলে উল্টো ধমক দেওয়া হতো। জিজ্ঞেস করা হতো। আপনি কোন মিডিয়াতে কাজ করেন। আপনার পত্রিকার বা টেলিভিশনের মালিকের নাম কি ? এজন্য বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ কেবল হাসিনার উন্নয়নের সাংবাদিকতার দেশে পরিণত হয়েছিল। যারা সমালোচনা করতে চাইতো তার জন্য কারাগার আর মামলা অবধারিত ছিলো। এজন্য অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে বিদেশে অবস্থূান নেন। বিদেশে বসে কেউ হাসিনার সরকারের সমালোচনা করলে দেশে থাকা তার পরিবারের ওপর চলতো মামলা. গ্রেফতার, নির্যাতন।

আর কারো গায়ে ইসলাম বা ধর্মীয় গন্ধ থাকলেতো কোন কথাই নাই। এজন্য লূকিয়ে লুকিয়ে কাজ করতে হতো ইসলামিস্টদের। কারো সামনে আসার সুযোগ ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম তার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সেই কঠিন মুহুর্তগুলোর কথা। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনের অনেকেই ছিলেন যাদের সাথে আমার মত ও আদর্শের মিল নেই। আমি আসলে দুইটাকে ডিল করেছি স্ব স্ব উপায়ে। কিন্তু যেকোনো মূল্যে আমার আসলে দুই জায়গায় ঠিক থাকা দরকার ছিল।

তিনি বলেন, জুলাই মাসের ৩ তারিখ শিবিরের কার্যকরী পরিষদের মিটিং ছিল। ওখানে আমি আধ ঘণ্টা বক্তব্য রেখেছিলাম, সেখানে আমি বলেছিলাম, এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত মানুষদের আদর্শের সাথে মিল থাকুক না থাকুক, ছাত্র শিবিরের অবশ্যই এই আন্দোলনকে সমর্থন করতে হবে। আমাদের পক্ষে যা যা সম্ভব, যেভাবে সাহায্য করা সম্ভব, আমরা যেন করি। এই আহবানে সেই মিটিংয়ে সবাই সাড়া দিয়েছিল। এরপর থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচীতে শিবির ওতোপ্রোতভাবে অংশ নেয় এবং সফল করে। জনশক্তি থেকে শুরু করে থাকা খাওয়া এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এছাড়া নতুন কর্মসূচি গ্রহণের মূল মেকানিজমেও অংশ নেয় শিবির। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবির কর্মসূচি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

বাংলা ব¬কেড কর্মসূচির অংশ নিতে বেলা আড়াইটার পর বিভিন্ন আবাসিক হল ও বিভাগের শিক্ষার্থীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন। বেলা সোয়া তিনটার মধ্যে গ্রন্থাগারের সামনে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শুরু হয় মিছিল-¯ে¬াগান। পরে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে বিকেল চারটার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। এ সময় শাহবাগ মোড় দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে বোরহান উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থীরা বিকেলে রাজধানীর চানখাঁরপুল মোড় অবরোধ করেন। বেলা পৌনে দুইটার দিকে সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করেন। এছাড়া আগারগাঁওয়ে সড়ক অবরোধ করেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এদিন সন্ধ্যায় আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আলোচনা শেষে ফিরে এসে হাসনাত আবদুল্লাহ জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর একদল প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করতে তাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়।’

৭ জুলাই কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সোয়া চার ঘণ্টা রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখেন। রাত আটটার দিকে অবরোধ তুলে নিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

এদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেলা ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবরোধ শুরু করেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি কয়েকটি সড়ক ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে শেষ হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এদিন চার দফা দাবিতে বাংলা ব¬কেড কর্মসূচি পালন করেন। বিকেল চারটায় নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে মিছিলের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির শুরু হয়। তবে পুলিশের বাধার মুখে মিছিলের গন্তব্য পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীরা নগরীর মুরাদপুর হয়ে বহদ্দারহাটের উড়ালসড়ক পর্যন্ত যেতে চাইলে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা পুলিশের উদ্দেশ্যে ‘ভুয়া, ভুয়া’ ¯ে¬াগান দেন।

কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে পথনাটক, কবিতা, গান পরিবেশন করে ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ জানায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সোমবার ৮ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ও বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা।

এদিন বেলা ১১টার দিকে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরালের সামনে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন এবং জাতীয় পতাকা নিয়ে জড়ো হন শতাধিক শিক্ষার্থী। পরে তারা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে প্রধান ফটক হয়ে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করেন।

এদিন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। বৃষ্টির মধ্যে দুপুর ১২টা থেকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন।

৭ জুলাই বিকেল চারটায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি অংশে অবস্থান নেন। ৪৫ মিনিট ধরে অবরোধের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল ১০ টা থেকে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে জড়ো হতে থাকেন। পরে বেলা ১১টায় দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। আধা ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীরা সড়ক থেকে সরে যান। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কয়েকটি সড়কে তারা বিক্ষোভ মিছিল করেন।

এছাড়াও বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাথালিয়ায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় মহাসড়কের দুই পাশে যানবাহন আটকা পড়ে।

দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মা জানিয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন রাজধানীর শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) শিক্ষার্থীরা। বিকেল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা রাজধানীর আগারগাঁও মোড় অবরোধ করেন। সোয়া ৬টার দিকে অবরোধ তুলে নিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) শিক্ষার্থীরা দুই ঘণ্টা সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বিকেল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে এ কর্মসূচির কারণে সড়কের দুই পাশে শত শত যানবাহন আটকে যায়। পরে এক দফা দাবি ঘোষণা করে অবরোধ তুলে নেন তারা।