স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে স্থানীয় সরকার বিভাগের উত্থাপিত এ-সংক্রান্ত চারটি আইনের সংশোধনী অনুমোদন করা হয়েছে। পরে বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এ তথ্য জানান।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। আসিফ মাহমুদ বলেন, ২০১৫ সালে ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয় এবং সে অনুযায়ী আইন সংশোধন করা হয়। এবার সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে।

তিনি বলেন, এর প্রেক্ষিতে সিটি কর্পোরেশন আইন ২০১৫ এর ৩২ এর ক ধারা, পৌরসভা আইন ২০১৫ এর ২০ এর ক ধারা, উপজেলা পরিষদ আইন ২০১৫ এর ১৬ এর ক ধারা এবং ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০১৫ এর ১৯ এর ক ধারা- এই ধারাগুলো বিলুপ্ত করার প্রস্তাব আজ উত্থাপন করা হয় এবং উপদেষ্টা পরিষদ তা অনুমোদন করে। আসিফ মাহমুদ বলেন, এর ফলে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আর কোন সুযোগ নেই, এখন থেকে আলাদা আলাদা প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে। তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হানাহানি কমে আসবে এবং যোগ্য প্রার্থীরা তাদের নিজেদের যোগ্যতার ভিত্তিতে জিতে আসতে পারবেন।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকার সংশোধনী অনুমোদন হওয়ার প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনের আগে হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে আসিফ মাহমুদ বলেন, চলমান সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই সংশোধনী আনা হয়েছে । তবে আগে-পরে কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা সম্পূর্ণ জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের ঐকমত্যের উপর এটি পুরোপুরি নির্ভর করে। উপদেষ্টা পরিষদের সভার বরাত দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণের জন্য পে কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে। এই কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে সর্বশেষ বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে গত ১০ বছরে নতুন কোনো বেতন কাঠামো হয়নি। সেজন্য সরকার মনে করেছে মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য করতে একটি নতুন বেতন কাঠামো হওয়া উচিত। এছাড়া গোপালগঞ্জে হামলার ঘটনায় সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠনের কথাও জানান তিনি।

মাইলস্টোন স্কুলে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, এরকম একটা শোক শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতিতে আমাদের সবার হৃদয় ভেঙে গেছে। কেউ নিতে পারছে না এই ঘটনা। এর মধ্যেও অনেকে গুজব ছড়াচ্ছে। সরকার এসব বিষয়ে কোন শক্ত পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে নমনীয় কিন্তু মনে রাখতে হবে গুজব ছড়ানো ফৌজদারি অপরাধ। গুজব সৃষ্টিকারীদের প্রতিরোধ করতে মিডিয়াকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি। উপদেষ্টা পরিষদে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি বিষয়ক আইএলও কনভেনশন ১৫৫ ও ১৮৭ এবং কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ক আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

এদিকে, কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে তার পরিবারের সদস্যদের তথ্যটি জানাতে হবে। এমন বিধান রেখে ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি) সংশোধন করছে সরকার। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিআরপিসি সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সভায় সভাপতিত্বে করেন।

সভা শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এসব তথ্য জানান। আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন থেকে যে পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার করতে যাবেন, তার যথাযথ আইডেনটিটি থাকতে হবে। নেমপ্লেট থাকতে হবে, আইডি কার্ড সঙ্গে থাকতে হবে এবং চাওয়ামাত্রই এসব দেখাতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘কাউকে গ্রেপ্তারের পর থানায় এনে পরিবারকে জানাতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘণ্টার বেশি সময় নেওয়া যাবে না। গ্রেপ্তার ব্যক্তি অসুস্থ বোধ করলে তার চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে।’ আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘কেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কে গ্রেপ্তার করেছে, গ্রেপ্তারের পর পরিবারের কার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছেÑসেসব তথ্য লিখিত থাকতে হবে। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃতদের তালিকা পুলিশ সদর দপ্তরে থাকতে হবে।’

৫৪ ধারায় পরিবর্তন আনা হয়েছে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, পুলিশের সামনে অপরাধ করেছে, এমন হয়ে থাকলে সে ক্ষেত্রে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে। অথবা পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে তাকেও গ্রেপ্তার করতে পারবে। অনলাইনে বেইল বন্ড এবং ডিজিটাল সমনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আসিফ নজরুল বলেন, এই আইন যদি সঠিকভাবে প্রতিপালন করা যায়, তাহলে ইচ্ছাকৃত কাউকে গ্রেফতার করে হয়রানি করা বা গ্রেফতার করার পর অস্বীকার করা কিংবা গুম করা এসব বন্ধে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।