আলোচিত আনুপাতিক হারে (পিআর) নির্বাচনের পদ্ধতিতে অধিকাংশ ভোটারের সমর্থনে সরকার গঠিত হবে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে আসনসংখ্যা বেশি পেলেও ভোট প্রাপ্তির হার থাকে কম। যে কারণে স্বাধীনতার পর থেকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে গঠিত সকল সরকারই ৫০ শতাংশের কম ভোট পেয়েছে। অধিকাংশ ভোটই ছিল সরকারের বিপক্ষে। প্রত্যেক সংসদীয় আসনে সমান সংখ্যক ভোটার না থাকায় অধিকাংশ আসন পেলেও সে অনুপাতে ভোটের সংখ্যা কম থাকে। আলোচিত পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বন্টন হবে। ১ শতাংশ ভোট পাওয়া দল তিনটি আসন পাবে। একটি আসনের জন্য অন্তত দশমিক ৩৩ শতাংশ ভোট পেতে হবে। যার ফলে একক কোন দল দেড় শতাধিক আসন পেয়ে ক্ষমতায় গিয়ে ফ্যাসিবাদী হওয়ার সম্ভাবনা রুদ্ধ হবে। গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে। এ ছাড়াও কালো টাকা, পেশীশক্তির প্রভাবসহ নির্বাচনী অধিকাংশ সমস্যারই সমাধান হবে।

সূত্রমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে একজন ভোটার শুধুমাত্র একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন এবং যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান তিনিই জয়ী হন। এই পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে শুধুমাত্র একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েকটি রাজনৈতিক দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) নির্বাচনের দাবি তুলছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পিআর পদ্ধতির ভালো দিক হলো- যে দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে। এতে করে ছোট-বড় সব দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকবে। সংসদে কোনো দলের একক কর্তৃত্ব থাকবে না। তখন রাজনৈতিক দলগুলো নীতিকেন্দ্রিক অর্থাৎ নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা শুধু রাজনৈতিক ভারসাম্যই নয়, গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর করার একটি বড় মাধ্যম। উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা ও দেশে বিভিন্ন নির্বাচনের বৈষম্যমূলক ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের এখন এ বিষয়টি নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

পিআর পদ্ধতির প্রবর্তন ও বিস্তার সর্ম্পকে জানা যায় যে, প্রথমবার ১৮৯৯ সালে বেলজিয়ামে চালু হয় পিআর পদ্ধতি।

বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে ৯১টি, অর্থাৎ ৫৪% দেশে, পিআর ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

উন্নত দেশের সংগঠন ওইসিডি’র ৩৬টি দেশের মধ্যে ২৫টি, অর্থাৎ প্রায় ৭০% দেশ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইলেক্টোরাল রি-ফরম সোসাইটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘পিআর পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে’- শীর্ষক একটি আর্টিকেলে বলা হয়, প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) নিজে কোনো নির্দিষ্ট ভোটিং সিস্টেম নয়। বরং এটি একটি ধারণা, যার উদ্দেশ্য হলো- একটি পার্লামেন্টে যেসব আসন থাকে, তা যেন ভোটের অনুপাতে বিভিন্ন দলের মধ্যে বণ্টিত হয়। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভোটিং পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে-সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট। এই পদ্ধতি বর্তমানে স্কটল্যান্ড (স্থানীয় সরকার) এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে (স্থানীয় সরকার ও বিধানসভা নির্বাচন) ব্যবহার করা হয়। এটি হচ্ছে- বড় আকারের এলাকা থেকে একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচন করা হয়। ব্যালটে ভোটাররা প্রার্থীদের নামের তালিকা পান, এবং তাদের পছন্দক্রমে নম্বর (১, ২, ৩) দিয়ে ভোট দেন। একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে হলে নির্দিষ্ট ভোটের কোটায় পৌঁছাতে হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- অ্যাডিশনাল মেম্বার সিস্টেম। যেটি ওয়েলস পার্লামেন্ট, লন্ডন অ্যাসেম্বলি এবং স্কটিশ পার্লামেন্টে ব্যবহার হয়। এক্ষেত্রে ভোটাররা দুইটি ব্যালট পান। একটি দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচন করেন। অন্যটি দিয়ে তারা একটি দলকে ভোট দেন। প্রথম ব্যালটে জয়ী ব্যক্তি সরাসরি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় ব্যালট থেকে নির্বাচিত হয় ‘অতিরিক্ত সদস্যরা’, যাতে পুরো পার্লামেন্টে ভোটের অনুপাতে দলগুলো আসন পায়। তৃতীয়টি হচ্ছে- পার্টি লিস্ট প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন। এই পদ্ধতি সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয়। প্রতিটি এলাকায় একাধিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। দলগুলো একটি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। ভোটাররা হয় একটি দলকে ভোট দেন, অথবা তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের থেকে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে তিন ধরনের পার্টি লিস্ট পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো হলো- ক্লোজ লিস্ট যা ভোটার শুধু দলকে ভোট দেন; ওপেন লিস্ট যা ভোটার প্রার্থীদেরও বেছে নিতে পারেন এবং সেমি ওপেন লিস্ট যা কিছু সীমিত প্রার্থী পছন্দের স্বাধীনতা থাকে। এই পদ্ধতিতে ফলাফল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব অনুপাতিক হয়- যত ভোট, তত আসন।

দেশে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। এই নির্বাচনে ভোট পড়ে ৫৫.৪ শতাংশ। বিএনপি সারাদেশে ৩০.৮১ শতাংশ ভোট পায় এবং ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ শতাংশ ভোট পায়, ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে তারা। জামায়াত ১২.১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮ আসনে জয়লাভ করে। একইভাবে জাতীয় পার্টি ১১.৯২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৫টি, কৃষক শ্রমিক লীগ ১.৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে পাঁচটি, সিপিবি ১.১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে পাঁচটি, ইসলামী ঐক্যজোট ০.৭৯ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি এবং ন্যাপ ০.৭৬ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি আসনে জয়লাভ করে। ওই নির্বাচনে জাকের পার্টি ১.২২ শতাংশ ভোট পেলেও কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি।

কিন্তু ওই নির্বাচন যদি পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক) পদ্ধতিতে হতো তাহলে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে সম্ভাব্য ফলাফলে বিএনপির আসন অনেক কমে যেত। মোট ৫৫.৪ শতাংশের ভোটের ফলাফলের হিসাবে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ ভোটের জন্য আসন পেত ৯২টি। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ শতাংশ ভোটের হিসাবে আসন পেত ৯০টি। একইভাবে ১২.১৩ শতাংশ ভোটের হিসাবে জামায়াত পেত ৩৬টি আসন, ১১.৯২ শতাংশ ভোটে জাতীয় পার্টি পেত ৩৫টি, ১.৮১ শতাংশ ভোটে কৃষক লীগ পেত ৫-৬টি, ১.২২ শতাংশ ভোটে জাকের পার্টি পেত ৩-৪টি, ১.১৯ শতাংশ ভোটে সিপিবি পেত ৩-৪টি, ০.৭৯ শতাংশ ভোটে ইসলামী ঐক্যজোট পেত ২-৩টি এবং ০.৭৬ শতাংশ ভোটে ন্যাপ পেত ২টি আসন।

ফলে, ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল মূল্যায়ন করলে এতে স্পষ্ট হয় যে, ছোট দলগুলো সংসদে বেশি আসন পেত। সংসদে একক কোন দলের কর্তৃত্ব কমবে। অন্য দলের সাথে জোট করে সরকার গঠন করতে হবে।