মো. রেজাউল বারী বাবুল স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর : সংসদীয় আসনের প্রতিটিতেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা, নির্বাচনী প্রচারণার গতি-প্রকৃতি এবং সাংগঠনিক শক্তি বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে প্রচারণা, সংগঠন ও জনসংযোগ-তিন ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিপরীতে বিএনপি ভুগছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, মনোনয়ন অসন্তোষ, বিদ্রোহী প্রার্থী ও সংগঠনের দুর্বল সমন্বয়ের সমস্যায়।
গাজীপুরের গ্রাম, শহর, শিল্পাঞ্চল সব জায়গায় এখন একটি কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে:
‘একবার জামায়াতকে দেখতে চাই, দাঁড়িপাল্লা কেমন করে!’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিএনপি এখনও দলীয় ক্ষোভ সামাল দিতে ব্যস্ত।
গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর): বিএনপির ক্ষোভ, জামায়াতের সংগঠিত অগ্রযাত্রা
কালিয়াকৈর উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত গাজীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণার দেরি শুরুতেই হতাশা সৃষ্টি করে।একাধিক নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় অনিশ্চয়তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। অনেকের ধারণা ছিল বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুলকে মনোনয়ন দেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হন সাবেক কালিয়াকৈর পৌর মেয়র মজিবুর রহমান, যিনি বলেছেন, দলীয় ঐক্যের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বিজয় সম্ভব।
তবে সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি ভেতরে বিদ্রোহী মনোভাবকে উস্কে দিয়েছে। স্থানীয় নেতা ও পর্যবেক্ষকেরা স্বীকার করছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীর সম্ভাবনা এখনও পুরোপুরি শূন্য হয়নি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী সাবেক সচিব শাহ আলম বকশি নিয়মিত গণসংযোগ, শ্রমিক এলাকা সফর, উঠান বৈঠক ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিজেকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরছেন। তিনি বলেন,
বারবার ভোট দিয়ে মানুষ অধিকার পায়নি। এবার জনগণ এমন নেতৃত্ব চায়, যারা কথা নয়, কাজ দিয়ে জবাব দেবে। দাঁড়িপাল্লা সেই আস্থার প্রতীক।
স্থানীয় ভোটারদের একটি বড় অংশ মনে করছেন, দীর্ঘদিন পর এই আসনে সংগঠিত ও বিকল্প নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছে।
গাজীপুর-২ (গাজীপুর সদর) : শিল্পাঞ্চল ও শ্রমিক অধ্যুষিত গাজীপুর-২ আসনে বিএনপি প্রার্থী এম মনজুরুল করিম রনি, মরহুম মন্ত্রী অধ্যাপক এম এম মান্নানের ছেলে। তিনি বলছেন, মানুষ আমাদের অতীত উন্নয়ন মনে রেখেছে, তাই আবার সুযোগ দেবে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে এই আসনে শ্রমিক ভোটারই নির্ধারক। তাদের মজুরি, নিরাপত্তা, বাসস্থান ও ন্যায্য অধিকার মূল ইস্যু। জুলাই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শহর এলাকায় কিছু চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের ঘটনার কারণে বিএনপির প্রতি অনীহা বাড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে জামায়াত প্রার্থী হোসেন আলী শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, শ্রমিককে শুধু ভোটের সময় নয়, সারাবছর সম্মান দিতে হবে। ইসলামে শ্রমিকের ঘামের মর্যাদা আছে। শোষণ নয়, ন্যায্যতার ভিত্তিতে শিল্পাঞ্চল পরিচালনা হবে। এছাড়া সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জমিদখলের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেব।
স্থানীয় শ্রমিকরা মনে করছেন, জামায়াতের বক্তব্য তাদের বাস্তব জীবনের সমস্যার সঙ্গে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর) : শ্রীপুর ও সদর উপজেলার অংশ নিয়ে গঠিত গাজীপুর-৩ জামায়াত প্রার্থী ডা. জাহাঙ্গীর আলম শান্তি, নিরাপত্তা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের বিষয়টি আগেই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, মানুষ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জমিদখলের রাজনীতি থেকে মুক্তি চায়। ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতিই পারে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করতে।
স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জামায়াতের সংগঠন ও কর্মীদের সক্রিয়তা এখানে বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
আসনে বিএনপি প্রার্থী ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও পেশাগত গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি জানান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছি এখন তাদের নিকোটি ভোট প্রার্থনা করছি। আশা করি তারা আমাদের নিরাশ করবেন। এছাড়া পরিবেশ বান্ধব শিল্প তৈরি, শিক্ষা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। সন্ত্রাস দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান দৃঢ় থাকবে। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন স্থানীয় দলীয় কোন্দল এখনও পুরোপুরি কাটেনি।
গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) : জামায়াত প্রার্থী সালাউদ্দিন আইয়ুবী বিএনপির দুর্বলতাকে সামনে আনেন এবং বলেন,কাপাসিয়ার মানুষ পরিষ্কার নেতৃত্ব চায়। চাঁদাবাজি, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ছাড়া কাপাসিয়ার সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ বিএনপি প্রার্থী শাহ মো. রিয়াজুল হান্নান। মরহুম হান্নান শাহর ছেলে, তরুণ ভোটারদের উপর ভরসা করছেন। তিনি বলেন, কাপাসিয়ার মানুষ দুঃশাসনের শিকার হয়েছে। এবার পরিবর্তনের জন্য ভোট দেবে। তবে বিএনপির ভেতরের বিভাজন ভোটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এ আসনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রফেসর ড. এম. এ. হাসেম চৌধুরী, যিনি বলেন, আমি জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ মনে করি। দলীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে থেকে শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সুশাসন ফিরিয়ে আনব। এই আসনে প্রার্থী পুনঃ বিবেচনা করা না হলে তিনি স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে নির্বাচন করবেন। এতে বিএনপির ভোট কিছুটা বিভক্ত করতে পারে, যা জামায়াতের জন্য পরোক্ষভাবে সুবিধাজনক।
গাজীপুর-৫ (কালিগঞ্জ): গাজীপুর-৫ আসনে বিএনপি প্রার্থী এ কে এম ফজলুল হক মিলন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বললেও মাঠে তার সাংগঠনিক উপস্থিতি সীমিত।
অন্যদিকে জামায়াত প্রার্থী মোঃ খায়রুল হাসান উন্নয়ন ভাবনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন,রাস্তা-ঘাট উন্নয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যুব কর্মসংস্থান, মাদক ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ-সবকিছু মিলিয়ে গাজীপুর-৫ হবে উন্নয়নের রোল মডেল। জনগণের করের টাকা জনগণের কল্যাণেই ব্যয় হবে।
তার নিয়মিত মাঠপর্যায়ের উপস্থিতি ও সুসংগঠিত প্রচারণা এই আসনেও জামায়াতকে এগিয়ে রাখছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজীপুরের পাঁচটি আসনে জামায়াতে ইসলামী সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ এবং লক্ষ্যভিত্তিক প্রচারণা চালাচ্ছে। বিএনপি এখনও অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ, বিদ্রোহী শঙ্কা ও সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
জামায়াতের প্রার্থীরা গ্রাসরুট স্তরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যেখানে নির্বাচনী সভা, উঠান বৈঠক, শ্রমিক-কৃষক ও যুবকদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ জোরদার হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অবস্থান আগামী নির্বাচনে গাজীপুরের ফলাফলে বড় প্রভাব ফেলবে।