গাজীপুরবাসীর বহু প্রতীক্ষিত গাজীপুর-৬ আসন বাতিল হবে, নাকি বহাল থাকবে—এর নির্ধারক শুনানি অনুষ্ঠিত হবে আগামীকাল মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) আপিল বিভাগের ফুলবেঞ্চে। প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ ভোটারের সংসদীয় এই আসনটি নির্বাচন কমিশনের গেজেট অনুযায়ী টঙ্গী, গাছা ও পূবাইল এলাকার বাস্তবতা মেনে গঠিত হয়, যা গাজীপুরের রাজনৈতিক, ভৌগলিক ও সামাজিক কাঠামোতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে।
গত ১০ নভেম্বর হাইকোর্ট বাগেরহাটের এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গাজীপুর-৬ আসন বাতিল করে বাগেরহাট-৪ পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়।
এ রায়ে ক্ষুব্ধ গাজীপুরবাসী, বিক্ষোভে উত্তাল টঙ্গী, গাছা, পূবাইল জুড়ে অসন্তোষের ঝড় বইছে। ইতোমধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন গাজীপুর-৬ পুনর্বহালের দাবিতে সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, কিংবা বিবৃতির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।
নির্বাচন কমিশনের গেজেটে যুক্ত হওয়ার পর দেখা যায়, টঙ্গী পূর্ব, টঙ্গী পশ্চিম, গাছা ও পূবাইল (৩৯ নং ওয়ার্ড) মিলিয়ে গাজীপুর-৬ একটি সমন্বিত নগরবাস্তুতন্ত্র। শিল্পাঞ্চল নির্ভর যাতায়াত, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের করসেবা, মেট্রোপলিটন পুলিশের আওতা—সবদিক থেকেই এই এলাকা একীভূত। হালনাগাদ ভোটার সংখ্যা ৫,৪০,২৫৪ জন, যা গাজীপুর-২ আসনের (৫,৬১,৬২৭ জন) খুব কাছাকাছি।
গাছা ও পূবাইলের ৮টি ওয়ার্ডে (৩২–৩৯) ভোটার সংখ্যা ১,৬৬,৫৯৫ জন। টঙ্গীর ১৫টি ওয়ার্ডে (৪৩–৫৭) ৩,৭৩,৬৫৯ জন ভোটার আছেন। অন্যদিকে পূবাইলের ৩টি ওয়ার্ড (৪০–৪২) গাজীপুর-৫ এ যুক্ত হওয়ায় গ্রামীণ-শহুরে ভারসাম্য তৈরি হয়েছে, যদিও পূবাইলবাসীর ক্ষোভও কম নয়।
গাছার ৩২ ও ৩৩ নং ওয়ার্ড (৩০,০১৯ ভোটার) গেজেট সংশোধনের মাধ্যমে গাজীপুর-৬ এ যুক্ত হওয়ায় পুরো আসনের জনসংখ্যা ও ভূগোলের ভারসাম্য আরও সুদৃঢ় হয়েছে।
জামায়াত মনোনীত গাজীপুর ৬ আসনে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ড. হাফিজুর রহমান বলেন, গাজীপুর-৬ আসনের প্রশ্নে আমরা কোনো আপস করব না। এটি গাজীপুরবাসীর রক্ত-মাংসের দাবী, আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। নির্বাচনী সীমানা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে এই আসনটির স্বপ্ন জন্মেছিল গাজীপুরের মানুষের মধ্যে—একটি প্রাণের আসন, যা ৬ লাখ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। হাইকোর্টের রায়ে সেই স্বপ্ন স্থগিত হওয়ায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ।
বিচার বিভাগের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে, তবে নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের সময় ও প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দিয়েছে—গাজীপুরবাসীর সেই আয়নার ওপর আদালতের হস্তক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ।
আমরা বিশ্বাস করি, আপিল বিভাগ সংবিধান, গণতন্ত্র ও জনগণের ন্যায্য প্রত্যাশা—সবকিছুই বিবেচনায় রাখবেন। আমরা আইন মানি, ন্যায়বিচার চাই। কিন্তু জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়ার মতো কোনো ষড়যন্ত্রের সামনে আমরা নতি স্বীকার করব না।
গাজীপুরের মানুষ একমত—এই আসন তাদের পরিচয়, গর্ব এবং ন্যায্য অধিকার। আন্দোলন চলছে, চলবে—কিন্তু এ আন্দোলন হবে জনগণের সমর্থন, শান্তিপূর্ণ দাবি এবং সাংবিধানিকতার ভিত্তিতে। আমরা গাজীপুরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নায্য অধিকার আদায়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। ইনশা আল্লাহ, গাজীপুর-৬ আসন পুনর্বহাল হবে, গাজীপুরবাসীর আশা পূরণ হবে।
বিএনপি নেতাদের প্রতিক্রিয়া
বিএনপিথর কেন্দ্রীয় নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, গাজীপুর-৬ বাতিলের মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকে কলঙ্কিত করে। আন্তরিক রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এই ক্ষত সারবে না।
বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সালাহউদ্দিন সরকার বলেন, ভোটারদের মাঝে এরই মধ্যে নতুন আসন নিয়ে ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। শুনানি বিলম্বিত হওয়ায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রাকিব উদ্দিন পাপ্পু বলেন, শতশত ব্যানার-পোস্টার ছাপানো, জনসংযোগে প্রচুর অর্থ ব্যয়, আর সব হারানোর শঙ্কায় গাজীপুরবাসী ক্ষুব্ধ ও উৎকণ্ঠিত।
শুনানিকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা
মঙ্গলবারের আপিল বিভাগের রায়কে কেন্দ্র করে টঙ্গী, গাছা ও আশপাশে তীব্র প্রতীক্ষা বিরাজ করছে। টঙ্গী সচেতন নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম খান কালা বলেন, প্রায় ৮ লাখ ভোটারের ওপর একজনের প্রতিনিধিত্ব—এটা বাস্তবসম্মত নয়। গাজীপুরের নগরবাসীর সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা না হলে আমরা আইনগত প্রতিকার চাইবো।
টঙ্গী প্রেসক্লাব সভাপতি আলহাজ্ব মেরাজ উদ্দিন বলেন, বাগেরহাটের রিটে গাজীপুরবাসী বঞ্চিত হবে—এটি মেনে নেওয়া হবে না। প্রয়োজনে প্রেসক্লাব থেকেও রিট করা হবে।
আইনি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এম আব্দুল্লাহ বলেন, সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদালতের হস্তক্ষেপ সংবিধানসম্মত নয়। নির্বাচন কমিশনের ওপর এ রকম চাপ বিচার বিভাগের অতিসক্রিয়তার উদাহরণ।
বিশ্লেষকদের মতে, গাজীপুর-৬ নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলেও এর ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের রাজনীতি ও ভোটারের ক্ষমতা কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।