আদর্শিক কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণে ওমরের মতো শাসক দরকার --ধর্ম উপদেষ্টা
প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার এলামনাই কনফারেন্স। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর মিরহাজিরবাগে প্রতিষ্ঠিত এই মাদরাসার সাবেক শিক্ষার্থীদের মিলন মেলায় এক অভুতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। গতকাল শনিবার রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপি এই মিলনমেলায় দেশের প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, আলিমে দ্বীন, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ এ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান ১২০টি ব্যাচের রেজিস্ট্রেশনকৃত ৩ হাজার মেধাবীর পদচারণায় মুখর ছিল সম্মেলন স্থল। বিদেশে সফররত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান অনলাইনে যুক্ত হয়ে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, তা‘মীরুল মিল্লাত, এক নামে যে মাদ্রাসাকে সারা দেশের মানুষ চিনে। বাংলাদেশে আরও হাজারো মাদরাসা আছে কিন্তু সেগুলো এতটা জনপ্রিয় হয় নি। এখান থেকে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীদের কাছে মাত্র দু'টো বিষয় আমরা চাই। দ্বীনি ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয়ে নিজেকে গড়ে তুলবে পাশাপাশি শিক্ষার আলোকে নিজেকে ও সমাজের পরিবর্তনে অবদান রাখবে।
তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার এলামনাই এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ও মাদরাসার অধ্যক্ষ ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলন উদ্বোধন ঘোষণা করেন মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ ও ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারি মাওলানা যাইনুল আবেদীন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হাসান। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল, জনপ্রিয় দাঈ ও বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. নকিব মোঃ নাসরুল্লাহ, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. শামসুল আলম, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মিয়া মুহাম্মদ নূরুল হক, জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর আব্দুস সবুর ফকির, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন আব্দুল্লাহ জাফরী, তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্ট এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কুরবান আলী, গভর্নিং বডি সদস্য প্রফেসর নুরুন্নবী মানিক, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলাম, ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, মাওলানা মোশতাক ফয়েজী, আব্দুর রহমান আলমাদানী, মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল ড. আবু ইউসুফ, হাবিবুল্লাহ মুহাম্মদ ইকবাল, হাফেজ আবদুল্লাহ আল আরিফ প্রমূখ।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় যারা সমৃক্ত ছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্যাদা দান করেন। এই মাদরাসার পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মহিলা মাদরাসা হয়েছে। টঙ্গী ক্যাম্পাস হয়েছে। এই মাদরাসা ফ্যাসিবাদের আমলে নানা হয়রানীর শিকার হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে এই মাদরাসার রেপলিকা তৈরি করার চেয়ে এই মাদরাসার মর্যাদা রক্ষা করা জরুরী। তিনি বলেন, এখান থেকে যারা শিক্ষিত হয়ে বের হবেন, তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা খুব বেশি না। একটি হচ্ছে দ্বীনি ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয় করা, এক্সিলেন্সি অর্জন করা। পান্ডিত্ব অর্জন করা। আর দ্বিতীয়টা এর চেয়ে বড়। এই শিক্ষার আলোকে নিজেকে ও সমাজের পরিবর্তনে অবদান রাখবে। যেই সমাজটা হবে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ। যার সার্টিফিকেট স্বয়ং রাসূল (সা:) দিয়ে গেছেন। আমরা নিশ্চিত সেই সমাজ আর ফিরে আসবে না। কিন্তু সেই সমাজের ছায়া ফিরে আসবে। তিনি বলেন, এই মাদরাসা থেকে লেখাপড়া করে তারা সমাজের বিভিন্ন জায়গায় অবদান রাখছে। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্রবেশ করছেন। তিনি বলেন, তা’মীরুল মিল্লাত প্রতিষ্ঠা স্বার্থক হয়েছে। তাদের অভিভাবকরা স্বার্থক হয়েছেন। মহান শিক্ষকরা স্বার্থক হয়েছেন।
তিনি বলেন, দুনিয়াতে এখন জানার অভাব বেশি। তবে তার চেয়ে বেশি অভাব মানার। চারিত্রিক সংকট মারাত্মক। দুর্নীতি সর্ব পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা যেমন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে, ঠিক তেমনি মাদরাসায় শিক্ষিতরাও দুর্নীতি থেকে মুক্ত নয়। সবাই নয়, অনেককে লিপ্ত হতে দেখা যায়। তিনি বলেন, এ সবের মধ্যেও ভালো মানুষ রয়েছে। এমনকি সাধারণ শিক্ষিতদের মধ্যেও সৎ মানুষ, কর্মঠ মানুষ রয়েছে। তবে এই সংখ্যাটা যথেষ্ট নয়। এই সংখ্যা আরো বাড়িয়ে তুলতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, যারা দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছেন, তারা ভাগ্যবান।
আ ফ ম খালিদ হাসান তার বক্তব্যে বলেন, তামীরুল মিল্লাত মাদরাসা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে, ইসলামী তালিমের সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়, যুগ উপযোগী ও চরিত্রবান জনগোষ্ঠী তৈরি করা, সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনে যে লোকবল দরকার তা তৈরি করছে। ইতিমধ্যে আমরা তার প্রত্যক্ষ করছি। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই মাদরাসা শিক্ষার্থীরা অবদান রাখছে। তিনি বলেন, তা’মীরুল মিল্লাতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা আরো বেশি। একটা ঘুনে ধরা সমাজ খুব বেশি দিন চলতে পারে না। আমরা যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আছি, তা বৃটিশ আমলের। আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর যে অভিপ্রায়, সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কাঠামো সাজাতে হবে। ধার করা কাঠামো দিয়ে চলবে না। নতুন রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি বলেন, আসুন আমরা স্বপ্ন দেখি। যে স্বপ্ন আমাদের ঘুমাতে দিবে না। ফেব্রুয়ারিতে আমরা আশা জাগিয়েছি। আমরা আশাবাদী একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দিতে পারবো। তিনি আরো বলেন, আমাদের আরো স্বপ্ন বাকী আছে। সেটা আরো পরে। সেই স্বপ্ন হচ্ছে একটা আদর্শিক কল্যাণ রাষ্ট্রের। যেখানে হযরত ওমরের মতো শাসক দরকার।
নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসার সাবেক শিক্ষার্থীরা এখন সমাজে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে খোদাভীরু নেতৃত্ব প্রয়োজন। সেই সৎ যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে নতুন বাংলাদেশ বির্নিমানে এই মাদরাসা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশ গড়ার কাজে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের জন্য তিনি আহ্বান জানান।
আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, আজকে আপনাদের জন্যে বিশেষত আমাদের জন্য খুব আনন্দের দিন। আজকে আপনারা প্রথম অ্যালামনাই কনফারেন্স করতে পারছেন। কারণ মহান জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিবর্তন হয়েছে। সকল জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি আমার সালাম এবং আমার সম্মান সকল শহীদদের প্রতি। এই জুলাই বিপ্লব যেটা হয়েছে এটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব হিসেবে দেখি। আমাদের বাঙালি মুসলমানের যে আত্মপরিচয়, সেই আত্মপরিচয় আমরা নতুন করে বুঝতে শিখেছি জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে।
স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, আসলে তা'মীরুল মিল্লাত মাদ্রাসা যে কতটা সুনাম অর্জন করেছে সেটা আমি টের পেলাম যখন ২০১৯ সালে মালয়েশিয়ার ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে একটু লেখাপড়া করতে গেলাম। তখন ওখানে গিয়ে দেখলাম তা'মীরুল মিল্লাতের ছাত্রদের খুব সুনাম এবং এটা দেখে আমি খুব গর্ববোধ করেছিলাম যে, বাংলাদেশের একটা মাদ্রাসার ছাত্রদের সুনাম আমি মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে পাচ্ছি। এটা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের একটা সময় ছিল। আসলে মুসলমানদের জন্যে ইসলামী এবং আধুনিক শিক্ষার যে একটি মিশ্রণ, একটি মেলবন্ধন দরকার এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটা তা'মীরুল মিল্লাত খুব সফলভাবে দেখাতে পেরেছে।
শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, এই মাদরাসার কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি। সাধারণ শিক্ষিতদের মধ্যে দ্বীনের ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে। সমাজের প্রত্যাশা পূরণে নেতৃত্ব দিতে মাদরাসা শিক্ষিতদের এগিয়ে আসতে হবে। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্ববিবেককে জাগিয়ে তুলতে হবে।
মূলত: ৪টি সেশনে বিভক্ত ছিল পুরো সম্মেলন। উদ্বোধনী সেশনের পর ছিল শিক্ষকদের স্মৃতিচারণমূলক সেশন ‘শিক্ষাগুরুর সাথে’। এই সেশনের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বক্তব্য রাখেন। দুপুরের পর ‘জনে জনে প্রাণে প্রাণে’ সেশনে ছিল পারস্পরিক কুশন বিনিময়, আড্ডা, পারস্পরিতক পরিচিতি, স্মৃতিচারণ ব্যাচভিত্তিক ছবি। সর্বশেষ ছিল সমাপনী সেশন। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। গভীর রাত অবদি চলা অনুষ্ঠানটি স্বত:স্ফুত, প্রাণবন্ত। সম্মেলনে দেশ বিদেশ থেকে সাবেক শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহন করেন।