ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন সমীকরণ নিয়ে এগুচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনের মাঠে না থাকায় এবার দলটি প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় সামনে রাখছে। নতুন এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিটি আসনে যোগ্য প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি। চলতি মাসেই দুই শতাধিক আসনে প্রার্থীর আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রীণ সিগন্যাল দেয়া হবে বলে দলটির একাধিক নেতা নিশ্চিৎ করেছেন। এছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন অভিযোগ স্থায়ীভাবে বহিস্কার হওয়া নেতাকর্মীদেরও দলে স্বপদে ফিরিয়ে আনছে। এরই মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই নেতাকর্মীদের বহিষ্কারাদেশ তুলে নিয়ে চিঠি ইস্যু করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর তাদের ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দিয়ে দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। আর যাদের অভিযোগ কম তাদের মিডিয়ায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ফিরিয়ে আনার নোটিশ দেয়া হচ্ছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলটি তফসিলের আগেই প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর কিছু সম্ভাব্য প্রার্থীকেও ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া হচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যেই প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করার লক্ষ্য বিএনপির, যাতে নির্বাচনী প্রচারণায় তারা পিছিয়ে না পড়ে। তফসিল ঘোষণার পর সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে দলটি। এছাড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের মিত্রদের পাশাপাশি বামপন্থীসহ আরও কয়েকটি দল নিয়ে বড় একটি নির্বাচনী জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে তারা। নতুন এই রাজনৈতিক সমীকরণে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, প্রার্থী চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে আসনভিত্তিক জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, স্বচ্ছ ইমেজ এবং বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, অন্য দলের প্রার্থী কেমন, সেটা বিবেচনার একটি দিক হতে পারে, তবে বিএনপি মূলত জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ও যোগ্য প্রার্থীকেই মনোনয়ন দেবে। তিনি বলেন, চলতি অক্টোবর মাসেই ২০০ আসনে বিএনপির একক প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হবে। এনসিপির সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা হচ্ছে। তবে বিএনপি আর এনসিপি জোটভুক্ত হবে কি না, সেটা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে বলে তিনি জানান।
সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদ নির্বাচন ধরে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দলীয় একক প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল দেবে বিএনপি। যদিও এর আগে বেশ কিছু নেতাকে গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয়েছে। এখন অনানুষ্ঠানিকভাবে শুধুমাত্র প্রার্থীকে জানিয়ে দেয়া হবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চূড়ান্ত প্রার্থী আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে দলটি। ওদিকে ইতিমধ্যে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি বৈঠক করে এরকম সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এসব বৈঠকে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় অংশ হিসেবে সারা দেশে পাঁচটি জরিপ করেছে দলটি। প্রতিটি ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করেছে। এ ছাড়া দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের কাছে ম্যাসেজ দিয়েছে দলটি।
সূত্র জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পাঁচটি জরিপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে, সরকারি, বেসরকারি, সাংগঠনিক এবং মিডিয়ার মাধ্যমে জরিপ করেছে দলটি। এর মধ্যে একটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে জরিপ হয়েছে। জরিপ চলাকালীন সময়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারেক রহমান। তাদের বলা হয়েছে, নির্বাচনে একক প্রার্থী দেয়া হবে। যারা মনোনয়ন পাবেন না তাদের মনোক্ষুণ্ন না হয়ে দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচনে বিজয়ী করে আনার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। দলের এই নির্দেশনা অমান্য করে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিপক্ষে যারা কাজ করবেন তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও মনোনয়নপ্রাত্যাশীদের সতর্ক করেছেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, জরিপ হচ্ছে। কমিটি থেকে মতামত নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে দিন-তারিখ বলা যাবে না। আমরা অনেকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেটি দলের পক্ষ থেকে শীঘ্রই জানানো হবে।
জানা গেছে, প্রার্থী চূড়ান্তের ক্ষেত্রে আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত ত্যাগী, সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, এলাকায় জনপ্রিয় ও ক্লিন ইমেজধারীদের প্রাধান্য দেবে বিএনপি। এই বিবেচনায় মনোনয়নে এবার চমক আসতে পারে। শতাধিক তরুণ প্রার্থীর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতে পারে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নির্বাচনে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের সমমনাদের ৫০টি আসন ছাড়ার চিন্তা করছে দলটি। এ বিষয়ে সমমনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। সমমনারাও তাদের দাবি উত্থাপন করছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের স্ব স্ব এলাকায় কার জনপ্রিয়তা কতটুকু তা জানতে ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন প্রার্থীসহ আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা ধরে এ জরিপ চালানো হয়। জানা গেছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের জন্য যাদের প্রস্তুতি ছিল কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে অংশ নেননি এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে যারা মনোনয়ন পেয়েছিলেন তাদেরও এ জরিপের অংশ করা হয়। তবে যাদের এলাকা ও এলাকার মানুষের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক আছে এবং শিক্ষিত, এনারজেটিক, যোগ্য, ত্যাগী ও দলের জন্য ডেডিকেটেড, বিশেষ করে দেশব্যাপী নতুন ভোটাররা যে প্রার্থীকে বেশি পছন্দ করেন এমন ব্যক্তিদেরই এবারের মনোনয়নে অধিক প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারক মহল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, আমাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা কাজ করছি। আর চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হবে সনাতন পদ্ধতিতে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকেই নির্বাচনের টিকিট দেবেন।
দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি এখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটের মাঠ সাজাচ্ছে। এজন্য ঢাকা ছাড়া ৯টি সাংগঠনিক বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৯ জন সিনিয়র নেতাকে। এ ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কারে ৩১ দফা এবং তারেক রহমানের ইতিবাচক রাজনীতির বার্তা নিয়ে সারা দেশ সফর করছে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় সভাসহ নানা সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিচ্ছেন দলের নেতারা।
নোয়াখালী-৫ আসনের বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশনায় তিনি তার এলাকা কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাটের মানুষের সঙ্গে গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। আসন্ন নির্বাচনে ধানের শীষের মনোনয়ন পেলে তিনি বিজয়ী হবেন বলে আশাবাদ ভ্যক্ত করেন।
এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতাকর্মীদের বহিষ্কারাদেশও তুলে নেয়া শুরু করেছে বিএনপি। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আওতাধীন নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী এবং ঢাকা মহানগর উত্তরের আওতাধীন পল্লবী থানার অন্তর্গত ২নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি এস এম গোলাম মোস্তফা মাস্টারের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেছে বিএনপি। গত ১০ নভেম্বর দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ২১ আগস্ট ফরিদপুরের নগরকান্দায় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় তাদের পদ স্থগিত করে দলটি। গত ২৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মো. আমিরুজ্জামান আমিরের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এস আলম গ্রুপের গাড়িকাণ্ডে শাস্তির মুখে পড়া চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম এবং কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) দলীয় গঠনতন্ত্রের ৫ (গ) ধারা মোতাবেক দলীয় পদ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারসহ প্রাথমিক সদস্য পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল শুক্রবারও সাতজনের বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া হয়েছে। প্রত্যাহার হওয়া নেতৃবৃন্দরা হলেন, ময়মনসিংহ দক্ষিণের ভালুকা উপজেলার সাবেক আহবায়ক ফখর উদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, গাজীপুর মহানগরের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রাকিবুল উদ্দিন সরকার পাপ্পু, চট্টগ্রাম উত্তরের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আমিন চেয়ারম্যান, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সাবেক আহবায়ক রুহুল আমিন দুলাল, নীলফামারীর জলঢাকার সাবেক সভাপতি ফাহমিদ ফয়সাল চৌধুরী কমেট, রংপুরের সাবেক সদস্য মোকাররম হোসেন সুজন এবং রংপুরের সাবেক সদস্য মোঃ আলি সরকার। এদেরকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছিলো।
জানা গেছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দল থেকে বহিষ্কৃত শতাধিক নেতাকে ফিরিয়ে আনা হবে। নির্বাচনের আগে পর্যায়ক্রমে সবার বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেবে বিএনপি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর মাঝে চাঙাভাব ফিরিয়ে এনে দলকে আরও শক্তিশালী করাই এর প্রধান লক্ষ্য।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অনেকে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য দলের কাছে আবেদন করেছেন। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে। তবে এটি একটি চলমান প্রক্রিয়ার মতো বিষয়। কেউ অন্যায় বা ভুল করলে কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে দলের বিধি অনুযায়ী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। আবার শোধরানোর চেষ্টা করলে তাকে সুযোগও দেওয়া হয়ে থাকে।
জানা গেছে, অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচন অনেক কঠিন হবে বলে মনে করছে বিএনপি। এমন অবস্থায় তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মাঝে চাঙা ভাব ফিরিয়ে এনে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে চায় দলটি। এজন্য বিভিন্ন সময় দল থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সবুজ সংকেতও পেয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত অনেক নেতা।