রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেছেন, প্রিয় রাজনৈতিক দলের সদস্য বৃন্দ, বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মতভেদ থাকবে, কিন্তু সেই ভিন্নমত নিরসনে আলোচনা হবে। গণতন্ত্রের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যাতে মুখ দেখাদেখি যাতে বন্ধ না হয় সেই লক্ষ্যে জাতীয় স্বার্থে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, ধর্ম, দর্শন, মত যার যার, রাষ্ট্র আমাদের সবার। গতকাল বুধবার বিকেলে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান উপলক্ষে রাজধানীতে বিজয় র্যালি-পূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই আহ্বান জানান।
নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিকাল সাড়ে তিনটায় শুরু হয় সংক্ষিপ্ত সমাবেশ। প্রধান অতিথি তারেক রহমানের বক্তব্যের পর সাড়ে চারটায় বিজয় র্যালি শুরু হয়। বর্ণাঢ্য এই র্যালিতে ঢাকা মহানগর ছাড়াও আশ-পাশের জেলাগুলো থেকেও নেতা-কর্মীরা ব্যানার-ফেষ্টুন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা নিয়ে অংশ নেয়। ফকিরাপুল থেকে কাকরাইলের মোড় পর্যন্ত দীর্ঘ সড়কে হাজার হাজার কর্মীর উপস্থিতি জনসমুদ্রে রূপ নেয়। তারেক রহমানের বক্তব্যের পর বিকাল সাড়ে চারটায় বিএনপি মহাসচিব বেলুন উড়িয়ে বিজয় র্যালির উদ্বোধন করেন।
বিজয় র্যালিটি বিজয় নগর, পল্টন মোড়, জাতীয় প্রেসক্লাব, কদম ফোয়ারা, মৎস্যভবন মোড়, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন সড়ক দিয়ে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। ঢাকা ছাড়াও সকল বিভাগীয় শহরে একযোগে বিজয় র্যালীর কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
তারেক রহমান বলেন, জনগণের রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে বিএনপি কী ধরণের রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনীতি পরিচালনা করবে দলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ৩১ দফার মাধ্যমে একটি রূপরেখা জনগণের সামনে আমরা উপস্থাপন করেছি। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শ করে সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে। দেশ এবং জনগণের কল্যাণে এই সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিএনপি জনগণের সমর্থন এবং সহযোগিতা চায়।
সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান মঙ্গলবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে একটি সময়সীমা ঘোষণা করেছে। জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নের দাবিতে জুলাই সনদ ঘোষণা করা হয়েছে। জনগণের অধিকার বাস্তবায়নের এইসব উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার যাত্রা পথে বর্তমানে আমরা ইতিহাসের যে সন্ধিক্ষণ পার করছি, এই ঐতিহাসিক সময়টির জন্য দেশের গণতান্ত্রিক জনগণকে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ফ্যাসিবাদ শাসনের দীর্ঘ সময়ে এই আন্দোলনে আমরা আমাদের হাজারো সহকর্মীকে হারিয়েছি, আমাদের অনেক সন্তান-স্বজনের বুকের তাজা রক্ত দেখতে হয়েছে।
তিনি বলেন, বিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপিসহ বিরোধী দল এবং মতের নেতাকর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির এমন নেতা রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে শতাধিক, দুই‘শ, তিন‘শ মামলা রয়েছে, এমনকি ৪ শতাধিক মামলা রয়েছে। গুম- অপহরণের শিকার হয়েছেন বিএনপিসহ বিরোধীদলের শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মী। শুধুমাত্র ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিদের বন্দুকের নল থেকে মায়ের কোলে থাকা চার বছরের শিশুও রেহাই পায়নি। ক্ষমতালোভী ফ্যাসিস্টদের কারণে আমাদের অনেক সাহসী সেনা কর্মকর্তা হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে, বিডিআরের নাম পর্যন্ত পাল্টে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের মনোবল।
তারেক রহমান বলেন, পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের আমলে দেশ অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। আমি বলব আজকের এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোর পথে যাত্রা। তবে এই যাত্রা কিন্তু খুব সহজ নয়। বর্তমানে দেশের জনগণের সামনে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক অপার সম্ভাবনা এবং সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা যদি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের জনগণের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি, জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাবে না।
তিনি বলেন, দেশকে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবে না, আমাদেরকে আর কখনো ’২৪ এর দৃশ্য দেখতে হবে না। আমি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আপনার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য, আপনার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য একজন নগরিক হিসেবে আপনার সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে। যিনি যে রাজনৈতিক দলের সদস্য হন না কেন আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার প্রতিবাদ শাসন আমলে আমরা কেউ নিরাপদ ছিলাম না, আমাদের সন্তানেরা নিরাপদ থাকতে পারেনি।
গণতন্ত্র না থাকলে কেউই আমরা নিরাপদ নই উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, আমাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, আমাদের সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য সমগ্র বাংলাদেশটাকেই বর্বর বন্দিখানা, আয়নাঘর বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। দেশে যদি গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন না থাকে তাহলে নারী কিংবা পুরুষ সংখ্যা লোক কিংবা সংখ্যা আমরা কেউই নিরাপদ নই। একমাত্র গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনই আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারে। জনগণের গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারের জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারগুলোর সুষ্ঠ এবং চর্চা করি।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, সালাহ উদ্দিন আহমদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির রফিকুল আলম মজনু, উত্তর বিএনপির আমিনুল হক প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। র্যালীতে বিএনপির সিনিয়র নেতারাসহ কেন্দ্রীয়, অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বেই আগামীতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হবে খুব শিগগিরই। আমাদের জুলাই ঘোষণাপত্র হয়েছে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি ৩১ দফা বাস্তবায়িত হতে চলেছে সংস্কারের মধ্য দিয়ে। আসুন, আজকে শপথ গ্রহণ করি যে, আমরা সত্যিকার অর্থেই একটা সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলব।
মির্জা আব্বাস বলেন, বুঝতে হবে এটা একদিনের সফলতা নয়, এই সফলতা ৩৬ দিনের অর্জন নয়, এই সফলতা সার্বিক ১৭ বছরের আন্দোলনের ফসল। আজকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কেউ এক এগারোর ষড়যন্ত্রে আছেন, কেউ আমার দলের বক্তব্যকে অপোজ করেছেন।