আজ ১৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ৮০তম জন্মদিন। নানা রোগে অসুস্থ বেগম জিয়া গুলশানের বাসা ফিরোজাতেই জন্মদিন পালন করবেন। প্রতিবছর দলের পক্ষ থেকে দিবসটি ঘিরে কেককাটাসহ নানা কর্মসূচি থাকলেও গত কয়েকবারের ধারাবাহিকতায় এবারও সেটি থাকছে না। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ ১৫ আগস্ট শুক্রবার খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে দেশব্য্যাপী দোয়া মাহফিলের কর্মসূচি পালন করা হবে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার আরোগ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা, দেশবাসী ও দলের নেতাকর্মী যারা ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন, তাদের রুহের মাগফেরাত ও অসুস্থদের আশু সুস্থতা কামনায় সারাদেশে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপির উদ্যোগে দলীয় কার্যালয়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

সূত্র মতে, বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট পশ্চিম দিনাজপুরে (ভারতের জলপাইগুড়ি) জন্ম গ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী গ্রামের বিখ্যাত মজুমদার বাড়ি। পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ও মা তৈয়বা মজুমদার। ১৯৬০ সালে দিনাজপুর সরকারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন খালেদা খানম পুতুল। পরে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে লেখাপড়া করেন তিনি। কলেজে পড়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়া দম্পতির দুই সন্তান তারেক রহমান পিনু আর আরাফাত রহমান কোকো। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান কোকো। ১৯৮১ সালের ৩১ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে নিহত হন। এ সময় পর্যন্ত গৃহবধূই ছিলেন খালেদা জিয়া। পরে দলের নেতা-কর্মীদের আহ্বানে বিএনপির হাল ধরেন তিনি। ন্যায়নীতি ও আদর্শের কারণে তিনি দেশে এবং বিদেশে আপহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বেগম খালেদা জিয়া তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন হিসেবে একটানা ৩৮ বছর পূর্ণ করলেন স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে সর্বোচ্চ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দল বিএনপির বর্তমান চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।

বেগম খালেদা জিয়ার শৈশব ও কৈশোর জীবন অতিবাহিত হয় দিনাজপুরের মুদিপাড়া গ্রামে। তার পিতা এস্কান্দার মজুমদার পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ছিলেন দিনাজপুরের চন্দবাড়ির মেয়ে। বেগম খালেদা জিয়া পড়াশোনা করেন দিনাজপুর মিশন স্কুল এবং গার্লস স্কুল সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের পর জাতির সংকট মুহূর্তে একজন সার্থক গৃহবধূ ও মা থেকে বেগম জিয়া বিএনপিতে অপরিহার্য হয়ে পড়েন। বাস্তবতার নিরিখে তাকে রাজনীতিতে আসতে হয়েছে। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর আহ্বানে তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপির একজন প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে তিনি আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা, সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল তিনি দলের বর্ধিত সভায় প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের অসুস্থতায় তিনি ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন এবং একই বছরের ১০ মে বিএনপির চেয়ারপার্সন হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথমবার নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে ১ সেপ্টেম্বর দলের চতুর্থ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বার, ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে তৃতীয়বার এবং ২০২০ সালের ১৯ মার্চ দলের দশম কাউন্সিলে চতুর্থবারের মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।

বিএনপির চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েন বেগম খালেদা জিয়া। সাবেক সেনা প্রধান লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে বেগম জিয়া তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরশাদের দীর্ঘ ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শুধু আন্দোলনই নয়, তার সাথে কোনরকম সমঝোতা না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি আপসহীন ভূমিকা পালন করেন। যে কারণে বেগম খালেদা জিয়া ন্যায় ও আদর্শের প্রশ্নে একজন আপসহীন নেত্রী হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। বেগম জিয়া তার দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করেন। ১৯৮৩ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফায় আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে তৎকালীন আ’লীগ সভানেত্রী, বর্তমানে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতে পলায়নরত শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবার সিদ্ধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আরো তীব্র হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দল ভেঙ্গে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল ও ৫ দল ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নবসূচনা করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। একটানা নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। তারই সুবাদে বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে প্রথমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচন করে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। তিনি ৩ বার দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া দু’বার বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন।

বেগম জিয়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) দু’বার চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়ার একটি অনন্য রেকর্ড হচ্ছে গত ৫টি সংসদ নির্বাচনে ২৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই জয়ী হয়েছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম জিয়াই একমাত্র নেত্রী যিনি গণতন্ত্রের জন্য কোনো অন্যায় এবং দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে আপস করেননি। নানা ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী বেগম জিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে দূরদর্শীতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। সেনা সমর্থিত গত ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর তিনি আইনি লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে সবকটি মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তি লাভ করেন। কারাগারে থাকাকালে তাকে বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি যেতে রাজি না হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারীদের চেষ্টা সফল হয়নি। নীলনকশার নির্বাচনে তাকে হারানোর পর পতিত সরকার তাকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে।

খালেদা জিয়ার জন্মদিন এমন সময়ে পালন করা হচ্ছে যখন তিনি নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। কথিত দুর্নীতির মামলায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ তাকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার বিরুদ্ধে সাজার আদেশ দেয়া হয়। সেই থেকে তিনি দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশী সময় কারাগারে ছিলেন। এরপর তাকে নানা শর্তে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামিন দিলেও কার্যত তিনি ছিলেন গৃহবন্দী। তার বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা ছিল। গত বছরের ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পলায়ন করলে অন্তর্বর্তী সরকার তাকে মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলা বাতিল ঘোষণা করে। এখন তিনি মুক্ত থাকলেও নানা রোগে তিনি প্রায় শয্যাশায়ী। বিদেশ থেকে চিকিৎসা নিলেও সেভাবে তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। গুলশানের বাসায় পরিবারের সদস্যদের নিয়েই তার সময় কাটে। যদিও জাতির প্রয়োজনে তাকে মাঝেমধ্যে ভার্চুয়ালি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।