‘জুলাই’২৪ এর গণঅভ্যুত্থান : প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থান একটি আদর্শের ভিত্তিতে হয়েছে। শুধু কোটার জন্য এ আন্দোলন হয়নি। ন্যায়ের পক্ষে ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। এই আদর্শের সংজ্ঞায়ন করা প্রয়োজন। আন্দোলনকারীদের শহীদ হওয়ার আকাক্সক্ষা ছিল। কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়, রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে ফ্যাসিবাদ হতে না পারে। যারা গুম হয়েছে, তাদের তথ্য থাকার দরকার ছিল। তারা বেচেঁ না থাকলেও তা পরিবারকে জানানো দরকার রয়েছে বলে বক্তারা উল্লেখ করেন।

গতকাল শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে ‘জুলাই’২৪ এর গণঅভ্যুত্থান: প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনার এবং ‘২য় স্বাধীনতার শহীদ ও আহত যারা’ বইয়ের ইংরেজি ও আরবি ভার্সনের মোড়ক উন্মোচন এবং শহীদ স্মৃতি তথ্য সম্বলিত ওয়েবসাইটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তারা একথা বলেন। অর্থসহ পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। কুরআন তিলাওয়াতের পর নাতে রাসূল পেশ করা হয়। ‘২য় স্বাধীনতার শহীদ ও আহত যারা’ বইয়ের তথ্য সংগ্রহের উপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। সেমিনারে ‘জুলাই’২৪ এর গণঅভ্যুত্থান: প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও করণীয়’ শীর্ষক বিষয়ের উপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।

সেমিনারে আলোচ্য বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আযাদ, জামায়াতের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুল ও জামায়াতের ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর সেলিম উদ্দিন, বাংলাদেশ লইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি এড. জসিম উদ্দিন সরকার, গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান, দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আযম মীর শাহীদুল আহসান, লে. কর্ণেল (অব.) হাসিনুর রহমান, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি এস. এম. ফরহাদ প্রমুখ।

উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম, এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এড. মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, মোঃ আব্দুর রব ও জনাব মোবারক হোসাইন, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমীর মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাগপার সহ সভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান, জাগপার সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসাইন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মুফতি ফখরুল ইসলাম, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নির্বাহী সভাপতি এম. এ আজিজ হাওলাদার, সহ-সভাপতি জাফর ইকবাল ও সাংগঠনিক সম্পাদক খান আসাদ, শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আহত জুলাই যোদ্ধাবৃন্দ ও তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ প্রমুখ।

সেমিনার যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল, প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এড. এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান সভাপতির ভাষণে জাতীয় সেমিনারে উপস্থিত শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ, আহত জুলাই যোদ্ধাবৃন্দ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সাংবাদিকবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, উলামায়ে কেরামসহ সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে প্রথম স্বাধীনতা অর্জনের পরে আমরা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দ্বিতীয় বার স্বাধীন হয়েছি। মানুষের উপর মানুষের গোলামী খতম করে আল্লাহর গোলামী কায়েম করার জন্য আমাদের আবার তৃতীয় বার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। জাতীয় সংসদে আল্লাহর আইন পাশ করতে হবে। মানুষের রচিত কোন মতবাদ দিয়ে মানুষের মুক্তি আসবে না। এজন্য এ দেশে আল্লাহর আইন চালু করতে হবে।

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান আরও বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যারা জীবন দান করে তারা শহীদ। আল্লাহ তায়ালা শহীদদেরকে বিরাট পুরস্কারে ভূষিত করবেন। গত বছর জুলাই-আগস্টে যারা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছে তারা সবাই শহীদ। শহীদ ও আহতদেরকে সর্বোত্তম পুরস্কার দেয়ার জন্য আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করছি।

তিনি বলেন, আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আইন মেনে চলতে হবে। তাহলেই আমরা দুনিয়া এবং আখিরাতে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করবো। আল্লাহর বিধান কায়েমের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

শনিবার বাংলাদেশ জামায়াতের ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের হৃদযন্ত্রে বাইপাস অপারেশন করা হবে ইনশাআল্লাহ। তার সফল অপারেশন এবং দ্রুত আরোগ্যের জন্য দোয়া করতে তিনি দেশবাসী এবং বিদেশে অবস্থানরত সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, আমরা আমীরে জাময়াতকে বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বলেন, আমাদের দেশের চিকিৎসকদের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস আছে। তিনি দেশেই চিকিৎসা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

প্রবন্ধে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী পথ পরিক্রমার প্রথম মাইলফলক হওয়া উচিত জুলাই গণহত্যার বিচার। আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি যে, এই বিচার শুরু হয়েছে। সব অপরাধীরা এখনো ধরা পড়েনি। তাদের গ্রেফতার করতে হবে এবং জুলাই হত্যাকান্ডের বিচার যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে। এই বিচার যদি যথাযথভাবে সম্পন্ন না হয় তবে ভবিষ্যতে স্বৈরতান্ত্রিক মনমানসিকতার পুনরুত্থান হওয়ার উৎসাহ পাবে। প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদীদের দোসরদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জুলাই সনদ ও ঘোষণা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, ১৯৭১ সালের পর স্বাধীনতার চেতনার কথা বলে আওয়ামী লীগ জাতির উপর শোষণ, জুলুম, নির্যাতন, লুটপাট চালিয়েছে। লক্ষ লক্ষ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেশের সম্পদ লুটপাট করেছে। আবার ৯০ সালের গণঅভুত্থানের পরে আরেকটি দল ক্ষমতায় এসে লুটপাট, চাঁদাবাজি করেছে। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা আজও পূরণ হয়নি। তাই এবার আসুন আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লুটপাট ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করি। ইসলাম কায়েম করা ছাড়া লুটপাট, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি বন্ধ হবে না। দেশে দুর্নীতিমুক্ত সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চালু করতে হবে। তা-না হলে ভোট ডাকাতি, কারচুপি, ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ হবে না।

জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী শহীদদের তালিকা করার জন্য তিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে হলে সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করতে হবে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে মুসলমানদেরকে জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করে তাদের উপর জুলুম করা হয়েছে। জামায়াত-শিবির ও মসজিদের ইমামদেরকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানে একটি দলের মহাসচিব বলেছেন, দেশে দক্ষিণপন্থার উদ্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, দক্ষিণপন্থার উদ্ভব হইলে তাতে তাদের সমস্যা কি? দক্ষিণপন্থার ভয় দেখিয়ে আবার জুলুম-নির্যাতন চালানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলো। কিন্তু আজকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, জুলাই শহীদরা কোন দলের নয়। তারা গোটা জাতির গর্ব। কাজেই শহীদ পরিবারের লোকদেরকে চাকুরী দেয়া, আহতদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা সরকারের দায়িত্ব।

তিনি বলেন, জুলাইর গণহত্যা, বিডিআর সদর দপ্তরে সেনা অফিসারদের হত্যা, শাপলা চত্বরের গণহত্যা, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করাসহ হাসিনার আমলে সংঘটিত সকল হত্যার বিচার করতে হবে। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাদের কোনো ক্ষমা নেই।

হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সংস্কারকে আইনী ফ্রেমে না এনে নির্বাচন বানচালের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সংস্কারকে আইনী ফ্রেমে রূপ দিতে হবে। তা না হলে রাজপথে এ বিষয়ে ফায়সালা করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আন্দোলনের আদর্শের মধ্যে অন্যতম বিষয় হলো, দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন হয়েছে। একটি দল আধিপত্যবাদের কাছে মাথা বিক্রি করে দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। জুলাই আন্দোলনের ভিত্তিই হলো দক্ষিণপন্থার আবির্ভাব।

শিবির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান একটি আদর্শের ভিত্তিতে হয়েছে। শুধু কোটার জন্য এ আন্দোলন হয়নি। ন্যায়ের পক্ষে ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলনকারীদের শহীদ হওয়ার আকাংখা ছিল। রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গিয়ে ফ্যাসিবাদ হতে না পারে। শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলন শুরু করেছে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি, শিক্ষা কমিশন করা হয়নি। যারা গুম হয়েছে, তাদের তথ্য থাকার দরকার ছিল। তারা বেচেঁ না থাকলেও তা পরিবারকে জানানো দরকার রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।