ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চাপে পড়ে তাদের ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের খেতাব পাওয়া জাতীয় পার্টিও। কারণ, শেখ হাসিনার পাতানো নির্বাচন যখন সব বড় দলগুলো বর্জন করেছে, তখন তারা ভোটে গিয়ে বিরোধী দল হয়েছে এবং কার্যত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘হাতের পুতুল’ হয়ে সংসদে থেকেছে।
ফলে গত বছরের ৫ আগস্টের পর অর্ন্তর্বতী সরকার দায়িত্ব নিলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবির সঙ্গে দলটির দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টির নেতাদের বিচারের দাবিও উঠতে শুরু করে। বিক্ষিপ্ত ভাবে ওঠে তাদের নিষিদ্ধের দাবিও। পরে সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে জাপা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়।
তবে হঠাৎ করে আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের চাপে দলটি। এবারের চাপটা প্রবল, সঙ্গে পতিত আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে জোরেশোরে উঠেছে তাদের নিষিদ্ধের দাবি। রাজনীতির মাঠসহ সামাজিক মাধ্যমেও এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল।
এই দাবি আর আলোচনার মাঝেই শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। অভিযোগ ওঠে, দলবল নিয়ে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করতে গিয়েছিল গণঅধিকার পরিষদ। জাপার নেতাকর্মীরা তা প্রতিহত করতে গেলেই সংঘর্ষ শুরু হয়।
এসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও যৌথবাহিনী ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর অবস্থায় নুর বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তিনি মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং নাকের হাড় ভেঙে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সেই ঘটনার রেশ না কাটতেই শনিবার বিকেলে আবারও জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সংঘর্ষে জড়ায় দলটির নেতাকর্মীরা ও গণঅধিকার পরিষদ। ভাঙচুর করা হয় জাপার কার্যালয়, দেওয়া হয় আগুন। এতে ভেতরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন জাপার মহাসচিব শামীম হোসেন পাটোয়ারসহ বেশ কয়েকজন নেতা।
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এগিয়ে গেলে তাদের সঙ্গে হামলাকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ জলকামান ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে হামলাকারীদের সরিয়ে দেয় এবং অবরুদ্ধ জাপা মহাসচিবসহ নেতাকর্মীদের উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে আসে। বর্তমানে সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
যে কারণে জাপা নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে
জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন এই দলটি ‘গণহত্যাকারী’র তকমা পাওয়া আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ। গণঅভ্যুত্থানের আগে চুপচাপ সমর্থন জানালেও গত এক বছর ধরে দলটি দাবি করছে, তারা হাসিনার দুঃশাসনের প্রতিবাদ করেছিল এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল।
অন্যদিকে আবার জাপার চেয়ারম্যান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রতিবাদও করছেন। পাশাপাশি টানা ১৬ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে সেটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না বলেও মন্তব্য করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এমন দ্বিচারিতার জন্য জাপা নিষিদ্ধের দাবি আগে থেকেই ছিল, নুরের ওপর হামলার পর সেটি আরও জোরালো হয়েছে।
জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে অর্ন্তর্বতী সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। শনিবার দলের কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই দাবি জানিয়েছেন।
রাশেদে বলেছেন, ‘শুক্রবারের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনায় দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ করতে হবে। এছাড়া আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করতে হবে।’
জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের যে দাবি গণঅধিকার পরিষদ তুলেছে, তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে জামায়াতে ইসলামী। শনিবার ঢাকা মেডিকেলে আহত নুরকে দেখতে গিয়ে এ কথা জানান দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। পাশাপাশি তার দাবি, নুরের ওপর সুপরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে।
পতিত আওয়ামী লীগের মতোই জাতীয় পার্টিও নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গতকাল রোববার উপদেষ্টা ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের আমন্ত্রণে যমুনায় বৈঠক শেষে একথা বলেন দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
জামায়াত নেতা বলেন, জাতীয় পার্টির ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে বলেছি, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে যেভাবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনিভাবে জাতীয় পার্টিকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে।
ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশও। শনিবার বিকালে এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটির মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব এ দাবি জানান।
নেতৃদ্বয় নুরের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানান এবং বলেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের চিহ্নিত এজেন্ট জাতীয় পার্টিকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই। জাতীয় পার্টিকে ঘিরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের অপচেষ্টা সফল হতে দেওয়া হবে না, ইনশাআল্লাহ।’
বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সব বিতর্কিত নির্বাচন ও জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নে জাতীয় পার্টি সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, এর আইনগত দিক যাচাই-বাছাই করে কী করা যায় দেখব।’
শনিবার ঝিনাইদহে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয় উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রশ্ন, ‘গণহত্যা, সন্ত্রাস ও ফ্যাসিবাদের কারণে যদি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হতে পারে, তবে জাতীয় পার্টি কেন নিষিদ্ধ হবে না?’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশের মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে, মানুষের রক্ত নিয়ে খেলেছে।
জাতীয় পার্টির ভেতর দিয়ে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর চেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এসময় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার দায়-দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুরকে দেখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা আসিফ বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি এখন নানা ফরমেটে শক্তি প্রদর্শন করছে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা সম্মুখ সারির নেতৃত্বে ছিলেন, তাদের ওপর পরাজিত হওয়ার যে আক্রোশ, সেটা মেটানোর চেষ্টা করছে।
জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে শক্তিশালী তদন্ত কমিটি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, এই কর্মসূচি করার আগেও গণঅধিকার পরিষদ ও নুরুল হক নুরকে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সরকার এসব বিষয় খতিয়ে দেখবে বলে উল্লেখ করেন এই উপদেষ্টা। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ বলেন, কোনটা মব, আর কোনটা রাজনৈতিক কর্মসূচি সেই পার্থক্যটা বুঝতে হবে। রাজনৈতিক দল কিভাবে মব করে? একটি নিবন্ধিত দলের কর্মসূচিকে কীভাবে মব বলবেন?’ তিনি বলেন, প্রথমে হামলা হয়েছে জাতীয় পার্টির দিক থেকে।
আমরা এর আগেও দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এরকম উত্তপ্ত পরিস্থিতি হতেই পারে। কিন্তু এটাকে মব বলে একটা পক্ষকে নিউট্রালাইজড করা এবং আরেকটা পক্ষকে ফ্যাসিলিটি দেওয়া ঠিক হবে না। জাতীয় পার্টি একটি সুনির্দিষ্ট ও চিহ্নিত ফ্যাসিবাদী। আমরা দেখেছি বিগত সময়ে কিভাবে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী সংসদকে বারবার বৈধতা দিয়েছে জাতীয় পার্টি, কিভাবে ভারত থেকে প্রেসক্রিপশন এনে বাংলাদেশে কৃত্রিম সংসদ তৈরি করেছে, কৃত্রিম গণতন্ত্র দেখিয়েছে। এই চিহ্নিত ফ্যাসিবাদীদেরকে কোনোভাবে যদি কেউ সমর্থন দেয়ার চেষ্টা করে, সবাই মিলে তা প্রতিহত করতে হবে।