ইবরাহীম খলিল : আজ ৩০ জুলাই বুধবার। ২০২৪ সালের এই দিনটি ছিল মঙ্গলবার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের মঙ্গলবার রাত সোয়া ১১টার দিকে “মার্চ ফর জাস্টিস” ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা দিয়ে বলেন যে, ‘সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা, গুম খুনের প্রতিবাদে এবং জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে, ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের সব আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে আগামীকাল বুধবার “মার্চ ফর জাস্টিস” কর্মসূচি পালন করা হবে।’ দুপুর সাড়ে ১২টায় এ কর্মসূচি পালন করা হবে বলে ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়। ঘোষণায় আরও বলা হয়, আমরা সারা দেশের শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও সব নাগরিককে আমাদের কর্মসূচি পালনে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাদের দাবি আদায়ের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। এদিকে এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মঙ্গলবার মুখে ও চোখে লাল কাপড় বেঁধে ছবি তুলে তা অনলাইনে প্রচারের কর্মসূচি পালন করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন।

এদিন সরকারের রক্তচক্ষুকে চ্যালেঞ্জ করে রাজপথে থাকে শিক্ষার্থীরা। ডিবি হেফাজতে ৬ সমন্বয়ককে রেখেই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা প্রদর্শন করে। দিনের পর দিন হত্যা, খুন, জখম, গুম বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার্থীদের মনোবল ভাঙতে ব্যর্থ হয় জালেম সরকার। এদিন দেশপ্রেমিক আর ফ্যাসিজম দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় পুরো দেশ। সরকারের চেলাচামুন্ডারা সেদিন শোক পালনের ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা কালোর বিপরীতে বিপ্লবের রঙ কিংবা রক্তের রঙ লালকে বেছে নেয়। শিক্ষার্থীদের ঘোষণায় সারাদেশের মানুষ সংহতি জানিয়ে লাল রঙকে ধারণ করে। মূলত আন্দোলনকারীরা দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মুখে লাল কাপড় বেধে কর্মসূচি পালন করে। তাতে চরম উত্তেজনা তৈরি হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। মুখোমুখি অবস্থানে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে দেশজুড়ে। এই উত্তেজনার পরিসমাপ্তি ঘটে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে। এদিকে দিন যতই অতিবাহিত হতে থাকে, ততই ফ্যাসিস্ট সরকারের পায়ের তলার মাটি সরতে থাকে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারের আচরণের নিন্দা জানাতে থাকে। শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর ক্র্যাকডাউনের তীব্র নিন্দা জানাতে থাকে। এসব কিছু উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের ওপর স্টিমরোলার অব্যাহত রাখে সরকার। শেষ মুহূর্তে এসে আন্দোলন থামাতে গণগ্রেফতার, গণ অভিযান এবং বিরোধী মতের ওপর তান্ডব চালাতে থাকে। বলা হতে থাকে যে, হাসিনা এসব করেই তার নিজের পতন ত্বরান্বিত করে।

এদিন শিক্ষার্থীরা লাল কাপড় এবং ফেসবুক লাল করে যে প্রতিবাদের সূচনা করে তাতে জনমনে শিক্ষার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়তে থাকে। সুধী সমাজ থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও রাজপথে নামে মানবাধিকারের পক্ষে। শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন সবার মাঝে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে।

স্থানীয় ও আন্তর্জাাতিক মিডিয়ার খবরে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই গত সোমবার রাত থেকে ফেসবুকের প্রোফাইলে লাল রঙের ফ্রেম ব্যবহার শুরু হতে দেখা যায়। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, লেখক, সাংবাদিক, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেক মানুষ নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সংহতি জানান। মঙ্গলবার কোটা আন্দোলনকারীদের ডাকে সামাজিক মাধ্যমে প্রোফাইল ছবি লাল করে সহিংসতার প্রতিবাদ জানান সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। সরকারের পক্ষ থেকে এদিন সারা দেশে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা অনুযায়ী সরকার-সমর্থকদের অনেকে ফেসবুক প্রোফাইলে কালো রঙের ফ্রেম জুড়েন। তবে রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করেন আন্দোলনকারীরা।

আগের দিন সোমবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রোফাইলের ছবি লাল করেন। অনেকে আবার মুখে ও চোখে লাল কাপড় বাঁধা ছবিও নিজের প্রোফাইল পিকচার হিসেবে দিয়েছেন। এসব ব্যক্তির মধ্যে শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছিলেন।

কর্মসূচি পালনকারীরা জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ফেসবুকের প্রোফাইল লাল রঙে রাঙিয়েছি। এই লাল রঙ আমাদের নিহত শিক্ষার্থীদের রক্তের প্রতীক। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী সানজিদা জুঁই লাল রঙের ফেসবুক প্রোফাইল শেয়ার করে লেখেন, প্রহসনের শোক রূপান্তরিত হোক শক্তিতে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম বলেন, আমরা প্রোফাইল পিকচার লাল করেছি রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যানের জন্য। অত্যাচার, নির্যাতন করে নিরীহ শিক্ষার্থীদের যারা মারছে, তাদের আগে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তারপর না হয় রাষ্ট্রীয় শোক পালন করব। শিক্ষকদের মধ্যে সাইফুল আলম চৌধুরী লেখেন, এত মানুষের মৃত্যুর পরও কেন মানুষ কালোকে বেছে না নিয়ে লালকে বেছে নিল? আপনাদের ধ্বংসযজ্ঞ, ষড়যন্ত্র, তৃতীয় শক্তি, পানি ছিটানো, গুজব রোধ, নিরাপত্তা হেফাজত- এসব তত্ত্ব আর ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে এটা যে কত বড় শক্ত প্রতিবাদ, সেটা আপনাদের মতো বড় বড় ন্যারেটিভের জন্মদাতা ও প্রচারকের বোঝার ক্ষমতা নেই। কালো যেখানে শোকের প্রতীক, লাল সেখানে বিপ্লব আর ভালোবাসার রং। লাল শৌর্যবীর্য আর সাহসিকতার প্রতীক।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে ফেসবুক বন্ধ রাখা হলেও মঙ্গলবার বাংলাদেশ সরকারের টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নিজের ভেরিফায়েড প্রোফাইলে কালো প্রোফাইল পিকচার দেন। এছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতারা রাষ্ট্রীয় শোক হিসেবে নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলে কালো ফ্রেম সাঁটিয়েছেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, কেন্দ্রীয় নেতা বরিকুল ইসলাম, আবদুল আলীম খান, মুনেম শাহরিয়ার, রফিকুল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, রিয়াজুল ইসলামসহ অনেকের প্রোফাইলেই কালো ফ্রেম দেখা গেছে। ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম লেখেন, শিবির-ছাত্রদল, বিএনপি-জামায়াত সবাই দেখি আজ কমরেড হয়ে গেছে। তাদের ডিপি (ডিসপ্লে পিকচার) আজ লাল আর লাল। এমন কেন ওরা?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মুখে লাল কাপড় বেঁধে র‌্যালি করেন। মঙ্গলবার দুপুরে ক্যাম্পাসে দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মুখে লাল কাপড় বেঁধে র‌্যালি করেন। দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্যাম্পাস ও সড়কে মিছিলও করেন। রাজধানী ঢাকায় বেসরকারি নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাতটি স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ বাধা দেয়।

জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ ঘোষিত কর্মসূচি অনলাইনকেন্দ্রিক হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে মিছিল করে। সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জড়ো হন ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা। তাদের সঙ্গে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে সংহতি জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে তারা মৌন মিছিল বের করে। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে পুরোনো ফজিলাতুন্নেসা হলসংলগ্ন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিহতদের স্মরণে নবনির্মিত ছাত্র-জনতা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সামনে যায়। সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। পরে সেখান থেকে পুনরায় মিছিল একই পথে শহীদ মিনারে গিয়ে শেষে হয়। এরপর সেখানে সমাবেশ করেন তারা।

সমাবেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহমুদা আকন্দ, আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া, মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার, রায়হান রাইন, সাঈদ ফেরদৌস, আদিল মুহাম্মদ খান, মো. মাসউদ ইমরান প্রমুখ বক্তব্য দেন। শিক্ষকরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ হত্যা, তাদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও আটকের ঘটনার প্রতিবাদ জানান।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকসমাজ’ ব্যানারে ১২টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে থেকে মাথায় ও মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দিকে যায়। দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুখে লাল কাপড় বেঁধে র‌্যালি করেন নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকবৃন্দ। মঙ্গলবার দুপুরে দেশব্যাপী ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুখে লাল কাপড় বেঁধে র‌্যালি করেন নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকবৃন্দ।

এদিন ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে প্রধান ফটকের সামনে আগে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকও ছিল তালাবদ্ধ। শিক্ষকেরা তালা খোলার অনুরোধ করলে পুলিশ তালা খুলতে বারণ করে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মী তালা খুলে দিলে শিক্ষকেরা প্রধান ফটকের সামনে সারিবদ্ধভাবে সমাবেশে মিলিত হতে থাকেন। এ সময় পুলিশের কর্মকর্তারা দ্রুত কর্মসূচি শেষ করার অনুরোধ করেন। পরে শিক্ষকেরা সেখানে সমাবেশ করেন। শিক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য দেন সালেহ হাসান নকীব, রায়হানা শামস ইসলাম, রেজাউল করিম, সাইফুল ইসলাম ফারুকী, ইসমত আরা, ফরিদ উদ্দিন খান, ইফতিখারুল আলম মাসউদ, ফরিদুল ইসলাম প্রমুখ।

রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে কর্মসূচি পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শিক্ষকদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘নিরস্ত্র ছাত্র হত্যার বিচার চাই’, ‘শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষক’ প্রভৃতি। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানান। এই কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নোভা আহমেদ, সাইফুল ইসলাম, মুশাররাত শর্মি হোসেন, সাকিব রহমান প্রমুখ অংশ নেন।

আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত-বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে গতকাল সকাল থেকে খুলনার শিববাড়ী মোড় ও এর আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে শুরু করেন। তবে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল শিববাড়ী মোড়ে আসে। পরে মোড়ের চারটি সড়ক অবরোধ করে বেলা দুইটা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।

একই দাবিতে দুপুর ১২টার দিকে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতাল চত্বর থেকে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে কিছতা এগোলেও পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা মহাসড়কে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয়ের সামনে মিছিলটি থামিয়ে দেয় পুলিশ। পরে মহাসড়কে পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পঞ্চগড় জেলার অন্যতম সমন্বয়ক ফজলে রাব্বি। তার বক্তব্যের পরপরই পুলিশের বাধায় সরে যান শিক্ষার্থীরা। এই কর্মসূচির আগে-পরে পাঁচজনকে আটক করে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা বলেন, পাঁচজনকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের অভিভাবকদের ডেকে কথা বলা হবে। তাদের মধ্যে নেতিবাচক কিছু পাওয়া না গেলে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর নেতিবাচক কিছু পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সারাদেশে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার, মুক্ত ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন দাবিতে বেলা ১১টার দিকে কিশোরগঞ্জের পুরোনো থানা এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা ছিল, হাতে ছিল লাল রঙের প্ল্যাকার্ড। কর্মসূচিস্থলে বিপুলসংখ্যক পুলিশের অবস্থান ছিল। আধা ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীরা রাস্তা ছেড়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে দুপুরে হবিগঞ্জ শহরের বসন্ত কুমারী গোপাল চন্দ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে নিজেদের মুখে লাল কাপড় বেঁধে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে জড়ো হন হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজ, হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ ও শচীন্দ্র ডিগ্রি কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা। আধা ঘণ্টা অবস্থান করার পর পুলিশ এলে ছাত্রীরা কর্মসূচি শেষ করে চলে যান।

শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে যশোরের কেশবপুরে সরকারি ডিগ্রি কলেজ মাঠে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে বিকেল চারটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক অবরোধ করেন তারা। পরে কলেজের মাঠে গিয়ে তারা কর্মসূচি শেষ করেন। এই কর্মসূচির সময় পুলিশের বিপুল সদস্যের অবস্থান ছিল।

প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ৩০ জুলাই সরকার ঘোষিত শোক দিবসকে প্রত্যাখ্যান করে শোকের কালো রং বাদ দিয়ে আন্দোলনকারী এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ, সাধারণ নাগরিক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশ এমনকি সাবেক সেনাপ্রধানও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাল প্রোফাইল ছবির মাধ্যমে কোটা আন্দোলনকারীদের সাথে সমর্থন জানান। এবার শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে নিজের ব্যক্তিগত প্রোফাইলের ছবি পরিবর্তন করেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। কাভার ফটো বদল করে তিনিও দিয়েছেন লাল রঙের ছবি, যা নজর কেড়েছে অনেকের। মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) রাতে তিনি তার প্রোফাইল পিকচার ও কাভার ফটো পরিবর্তন করেন। হাজারো মানুষ শেয়ার ও মন্তব্য করেন। বেশির ভাগ ব্যবহারকারী তার এমন পদক্ষেপের প্রশংসা করেন।

শিক্ষার্থীরা বলেন, এ লাল ফাগুনের লাল, বিপ্লবের লাল। চিত্রপরিচালক ও লেখক জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’-এর উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে ক্যাপশন দিয়েছেন, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব।’ অনেক শিক্ষার্থী আবার ছন্দের তালে লিখেছেন, ‘যৌবন তুমি আগুন হও, লাল পলাশের ফাগুন হও! আর আসছে ফাগুন অনেক দেরি, এক্ষুনি দ্বিগুণ হও। শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পরে পুরো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিশেষ করে তারকাদের প্রোফাইলও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে লালে লাল হয়ে যায়। তবে সবার নজর কাড়ে সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়ার লাল প্রোফাইলের দিকে।

ইকবাল করিম শুধু নিজের প্রোফাইল পিকচারই লাল করেননি, কভার ফটোতে দিয়েছেন লাল রং। মুহূর্তের মধ্যে ইকবাল করিমের প্রোফাইল শেয়ার করে অনেকে এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অনেকে শেয়ার করে লিখেছেন, ‘ফাগুনের আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে। সাবেক আর্মি চিফ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। আর কী লাগে!’

পরীক্ষার্থীদেও গ্রেফতারের প্রতিবাদ এবং তাদের জেল থেকে মুক্তির দাবিতে শত শত এইচএসসি শিক্ষার্থী পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয় এদিন। ২০২৪ ব্যাচ-এর 'শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে পাঠানো' বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব কলেজের মধ্যে রয়েছে নটর ডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ, ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজসহ আরও বেশ কয়েকটি।

শিক্ষার্থীরা জানিয়ে দেন, যতদিন পর্যন্ত না সকল অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারকৃত এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও অন্যান্যদের মুক্তি দেওয়া হয়, তারা এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নটরডেম কলেজের একজন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বলেন, 'অনেক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। আমরা সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাদের মুক্তি না দেওয়া হলে আমরা পরীক্ষায় বসব না।'

গ্রেপ্তার হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাহসিনের বাবা মোজাম্মেল হক একটি সরকারি কলেজের শিক্ষক। ৩০ জুলাই ছেলের মুক্তির জন্য তিনি চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (সিএমএম) আসেন। শিক্ষার্থীদের ধরপাকড় সম্পর্কে টিবিএসকে তিনি বলেন, 'শিক্ষার্থীদের এমন নির্বিচারে ধরপাকড় তাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি। বিনা অপরাধে তাদের আটকের কারণে তাদের ক্যারিয়ার নষ্টের পাশাপাশি মানসিকভাবেও শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাহসিনের আইনজীবী এ আল মামুন রাসেল বলেন, 'এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাতো এখন তাদের নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। তারাতো কোনো আন্দোলনে নেই। 'গ্রেপ্তার করে এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ হুমকিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে,' বলেন এ আইনজীবী।

সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুষ্ঠু ও মানসম্পন্ন তদন্ত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির জন্য বিদেশি কারিগরি সহায়তা নেওয়া হবে। জার্মানির রাষ্ট্রদূত আচিম ট্রোস্টার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সাক্ষাৎ করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির জন্য বিদেশি কারিগরি সহায়তা নেব, যাতে এটি যথাযথ, মানসম্পন্ন এবং উচ্চ মানসম্পন্ন হয়।’ তিনি আরও বলেন, এই তদন্তে সহায়তা নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে জাতিসংঘের (ইউএন) সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। প্রেস সচিব বলেন, জাতিসংঘ তাদের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে এবং বাংলাদেশও আগ্রহ প্রকাশ করেছে।