খুলনা-৪ আসন রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ১০২ নম্বর আসন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির তিন হেভিওয়েট নেতা মনোনয়ন পাওয়ার আশায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। অপরদিকে আসনটিতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের একক প্রার্থী নির্দিষ্ট হয়েই আছে। এ নেতারা নির্বাচনী এলাকায় ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার লাগানো শুরু করেছেন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সক্রিয়ভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন তাদের অনুসারীরা। সাধারণ ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুশল বিনিময় ও শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি নিজ অবস্থান তুলে ধরছেন কেউ কেউ। তবে এ আসনে ভোটের মাঠে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জাতীয় পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও সিপিবির কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

খুলনা জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য মতে, এ আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৪৮, নারী ভোটার ১ লাখ ৮২ হাজার ৬৪৮ ও হিজড়া ভোটার ২ জন।

বিএনপির একাধিক নেতা মনোনয়নের প্রত্যাশায় তৎপর হয়ে উঠেছেন। তারা হলেন-ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও কেন্দ্রীয় বিএনপির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, যুক্তরাজ্য বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ পারভেজ মল্লিক ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজ।

এ আসনে জামায়াতের একক প্রার্থী খুলনা জেলা নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা কবিরুল ইসলাম। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের একক প্রার্থী রয়েছেন কেন্দ্রীয় মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ। আর খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন এবারও প্রার্থী হবেন।

ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আজিজুল বারী হেলালের নামে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে শতাধিক মামলা ছিল। এসব মামলায় তিনি জেল খেটেছেন ও নির্যাাতিত হয়েছেন। ২০০৮ সালে আজিজুল বারী হেলাল ঢাকা-১৮ থেকে নির্বাচন করে হেরে যান।

খুলনা-৪ আসনে জামায়াতে ইসলামীর একক প্রার্থী খুলনা জেলা নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ মাওলানা কবিরুল ইসলাম। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর এ আসনের জামায়াত-ছাত্রশিবিরের নেতারা বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। নতুন করে উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে দলীয় কার্যালয় চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন নির্বাচনী এলাকায় সভা সমাবেশ করছেন জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা কবিরুল ইসলাম। বিতরণ করছেন লিফলেট ও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি চালাচ্ছেন গণসংযোগ। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। প্রস্তুতি চলছে। আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ঊঠান বৈঠক হচ্ছে। গণসংযোগ চলছে। সাধারণ মানুষ ইসলামের সাথে আছে জামায়াতে ইসলামীর সাথে আছে এমন মন্তব্য করেন তিনি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০৪টি মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছিল আমার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্টের পর অনেক মামলা থেকে নিষ্পত্তি পেয়েছি। এখনো অনেক মামলা রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা আমাদের দলের সাংগঠনিক অবস্থা মজবুত করার চেষ্টা করছি। দলকে আরো বেশি সুসংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি । সাথে সাথে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও চালাচ্ছি।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজ বিএনপির প্রার্থী হয়ে হেরে যান। পরাজয়ের পর বেশ কয়েক বছর এলাকায় সাংগঠনিক কাজে অংশ নিলেও গত কয়েক বছর খুলনায় তার কোনো তৎপরতা নেই। আবার আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী এলাকায় বেশ তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজ বলেন, বিগত দিনে রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়া উপজেলার মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে ছিলাম। আগামী দিনগুলোতেও থাকতে চাই। দল যদি মনে করে আমাকে নমিনেশন দেয় তাহলে আমি নির্বাচন করতে প্রস্তুত। দলীয় সিদ্ধান্তই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের একাধিকবার নির্বাচিত সভাপতি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বর্তমানে যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ পারভেজ মল্লিক। তিনি এ আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে সচেষ্ট রয়েছেন। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরপর দুই মেয়াদে ছাত্রদলের সভাপতি ছিলাম। পরে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করি। প্রবাসে থেকেও বিগত বছরগুলোতে দেশের মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য কাজ করেছি। বিগত নির্বাচনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছি। নিজের এলাকার দরিদ্র মানুষকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করেছি। বিশেষ করে মহামারি করোনাকালীন সময়ে। এলাকার মানুষ যদি চায় তাহলে আমি নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত আছি। দল যদি মনে করেন আমি যোগ্য তাহলে আমি একজন মনোনয়ন প্রত্যাশী। দল যদি বিবেচনা করে আমাকে নমিনেশন দেয় তাহলে জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।

মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের বৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ খুলনা মহানগরীর সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নির্বাচনের মাঠে তিনি নতুন নন। এর আগে ১৯৯১-৯৬ সালে তিনি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন এবং সম্মানজনক ভোট পান। এবার তার দল খেলাফত মজলিসের যে কয়টি আসনে নির্বাচনের জোরালো দাবি তুলেছে তার মধ্যে খুলনা-৪ অন্যতম।

খুলনাসহ জাতীয় অঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত মুখ মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন। বিশেষত ইসলামী অঙ্গনে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাশাপাশি দেশে এবং বিদেশে ইসলামবিরোধী সকল কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বারবার রোষানলের শিকার হয়ে কারাবরণ করেছি। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বর কেন্দ্রিক ঐতিহাসিক নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার দায়ে ১৬টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। কোন দিন হাজিরা দেওয়া লাগেনি। নিষ্পত্তিও হয়নি। ওভাবেই পড়ে আছে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত মিথ্যা মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়নি। এমন মামলা হেফাজতের অনেকের নামেই আছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির ইউনিয়ন থেকে জেলা শাখার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে যুক্ত ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি এই দলের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এলাকায় তার দলের একটি অনুসারীর সংখ্যা কম নয়।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, নির্বাচনের জন্য ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। আমার প্রস্তুতিও রয়েছে। জয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।

খুলনা-৪ আসনে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের শেখ আব্দুল আজিজ, ১৯৭৯ সালে আব্দুল লতিফ খান, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির শেখ সহিদুল ইসলাম, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মোক্তার হোসেন নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা ৪১ হাজার ৬৯৩ ভোট পেয়ে, ১৯৯৬ সালে আবারও আওয়ামী লীগের এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা ৫৬ হাজার ৫৬৬ ভোট পেয়ে, ২০০১ সালে বিএনপির এম নুরুল ইসলাম ১ লাখ ২ হাজার ৯৫৭ ভোট পেয়ে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মোল্লা জালাল উদ্দিন ১ লাখ ৯ হাজার ২১৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার মৃত্যুর পর ২০১৮ সালের উপ-নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনে আব্দুস সালাম মুর্শেদী, ২০২৪ সালেও আব্দুস সালাম মুর্শেদী নির্বাচিত হন।