অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিল, এই চারটি ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন, একরকম প্রস্তাব করেছে বিএনপি। গতকাল রোববার দুপুরে মধ্যাহ্ন বিরতির পরে সাংবাদিকদের কাছে ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ একথা জানান।

তিনি বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে আমরা শুনেছি আস্থা বিল এবং অর্থ বিলের ক্ষেত্রে প্রায় সবাই একমত। রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার্থে এবং সরকারের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার স্বার্থে আমরা চারটা বিষয় এখানে উল্লেখ করেছি। অর্থ বিল, সংবিধান সংশোধনী বিল, আস্থা ভোট এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন, এই চারটা বিষয় বাদে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে তাদের বক্তব্য এবং ভোট প্রদান করতে পারবে। তাতে তাদের সংসদ সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে না।

বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। তাতে বলা আছে, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন বা সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।

নারী আসন সংখ্যা প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা বলেছি, নারীদের আসন সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ তে উন্নীত করার ব্যাপারে আমরা একমত। কিন্তু সেটা বিদ্যমান পদ্ধতিতেই মনোনয়ন হবে.. সেটা আমাদের প্রস্তাবে বলেছি। তবে এটা (নারী আসন সংখ্যা উন্নীত) আমরা বলেছি, পরবর্তী পার্লামেন্ট গঠন করার পরে যখন তিন‘শ প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হবে এবং সংসদে এই সংক্রান্ত সংশোধনী গৃহীত হলে বর্তমানের ৫০ এবং আরো ৫০ নিয়ে যে ১০০ গঠিত হবে সেই ৪০০ সদস্য বিশিষ্ট সংসদে বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করে কোন পদ্ধতিতে তার পরবর্তী সংসদে নারী আসনের নির্বাচনটা হবে তখন সংসদে আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। বর্তমানের জন্য বিদ্যমান পদ্ধতি আমরা মনে করেছি যে এপ্রোপ্রিয়েট।

ভোটের ন্যূনতম বয়স ২১ এর ক্ষেত্রে বিএনপি দ্বিমত পোষণ করে বিএনপি এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, সকল স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে বিরোধী দলের নেয়ার প্রস্তাব এসেছে। আমরা বলেছি, এটা বাস্তবায়ন নয়। এটা সংসদের প্রাকটিস ও সংসদের ওপরে ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে আমরা এভাবে একমত হয়েছি যে, কিছু কিছু স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান পদে যেমন পাবলিক আন্ডারটেইকেন কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি এই জাতীয় কিছু কিছু কমিটি আমরা বিরোধী দলীয় মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করা যায়, এই বিষয়ে একমত হয়েছি।

গতকাল রোববার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করে বিএনপির প্রতিনিধিদল। সালাহউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিশনের সদস্যদের মধ্যে বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন ।

নজরুল ইসলাম খান বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনা করছি। আলোচনা অব্যাহত আছে মোটামুটি ভালো এগুচ্ছে। বেশ কিছু বিষয়ে কাছাকাছি এসছি, বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের দ্বিমত আমরা বলেছি। আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে এটাই স্বাভাবিক। আমরা বাকশালে বিশ্বাস করি না যে, এমন কিছু করা হবে, এটা সবাইকে বাধ্য হওয়া লাগবে। আমরা মনে করি, দেশ ও জনগণের স্বার্থ চিন্তা করে যা সংঘত যা সর্বাপেক্ষা উত্তম তেমন কিছুই হওয়া উচিত, তেমন কিছুই করা উচিত।

সংসদ নেতা এবং পার্টি প্রধান এক ব্যক্তি প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সংসদ নেতা এবং পার্টি প্রধান একই ব্যক্তি হতে পারবে না বলে প্রস্তাব করেছে কমিশন। আমরা এটা ওপেন রাখতে বলেছি। অপসনটা পলিটিক্যাল পার্টির এবং মেজরিটি পার্টি অব দ্যা পার্লামেন্টের অপসনটা রাখা উচিত। কারণ সেই মেজরিটি পার্টির সংসদে সংসদীয় দলের নেতা সেটা অন্য বিষয়, পার্লামেন্টের ভেতরের বিষয় না। আর পার্টির যে প্রধান তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এই প্রাকটিসটা তো আমরা দেখি না। আমরা যদি ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপ অফ গভমেন্টে দেখি, বৃটেনের বর্তমান প্রাকটিস দেখি যে, পার্টি চিফ প্রধানমন্ত্রী হন, এক্ষেত্রে এটা একটা ডেমোক্রেটিক প্রাকটিস তাতে কোনো অসুবিধা নাই। সেটা পার্টির স্বাধীনতা, সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা, ডেমোক্রেটিক প্রাকটিসের স্বাধীনতা। সুষ্ঠু ভোটে যে সংসদ নির্বাচিত হবে সেখানে আমাদের মনে রাখতে হবে জনগণ কাকে চায়। জনগণ হচ্ছে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং সেটা পার্লামেন্ট মেম্বার ও মেজরিটি পার্টির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করা উচিত।

তিনি বলেন, এখানে প্রশ্ন এসেছে যে, লিডার অফ দ্য হাউজ কি একই ব্যক্তি হবে? আমরা বলেছি যে, পার্টি চিফকেই যে প্রধানমন্ত্রী করবে সেটা আরেকজনকেও তো করতে পারে, অপশন থাকা উচিত। মেজরিটি পার্টি থেকে প্রধানমন্ত্রী হলেও যে সংসদ নেতা হবে কি হবে না, অন্যজন হতে পারে, সেটাতেও অপশন রাখা উচিত। আমরা এসব অপশন খোলা রাখতে বলেছি ডেমোক্রেটিক প্রাকটিসের জন্য।

সালাহউদ্দিন জানান, উচ্চ কক্ষে আসন সংখ্যা ১০০তে রাখার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সাথে একমত হয়েছে বিএনপি। উচ্চ কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, কারা আসবে, আনুপাতিক হারে আসবে কিনা সে বিষয়ে বিএনপি বলেছে যে, আগে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের সংশোধনীটা সংসদে গৃহীত হোক, দ্বি-কক্ষ গঠন হলে পরে সংসদে আলাপ করে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করা ভালো হবে।

আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ প্রাথমিকভাবে সংসদ উপস্থাপনের কথা উনারা বলেছেন। আমরা বলেছি, এটা সুবিবেচনা প্রসূত নয়। তাহলে কোনো চুক্তি রাষ্ট্র যেমন বাণিজ্যিক চুক্তি আছে, বাইলেটারাল চুক্তি, বিনিয়োগ চুক্তি আছে যে গুলো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নরমাল প্রাকটিস করা হয়। চুক্তির পরে সংসদে উপস্থাপনের যে বিধান যেটা আমরা যেন প্রয়োগ করি। এক্ষেত্রে আমরা বলেছি যে, ডিফেন্স যেসব চুক্তি হয়ে থাকে যেগুলোকে আমরা বলি যে, জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তি সেগুলো ক্লোজড সেশনে করাটাই উত্তম।

ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষেত্রে বিএনপি বিদ্যমান আইনের যথাযোগ্য যুগোপযোগী করার জন্য নীতিগতভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে একমত হয়েছে বলে জানান সালাহউদ্দিন।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা বলেছি, রাষ্ট্রপতিকে কী কী বিষয়ে ক্ষমতায়িত করে আইন প্রণয়ন করা যায় সেসব কিছু বিষয়ে এবং নিয়োগের কিছু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। সেগুলো নতুন আইন প্রণয়ন করে সংসদ প্রণীত করা যাবে। সেক্ষেত্রে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স এবং রাষ্ট্রপতিকে মোর এ্যামপাওয়ার করা সেটা নিশ্চিত করা হবে।

ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন কাউন্সিল (এনসিসি) প্রস্তাবে একমত নই উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এটা একটা নতুন ধারণা বাংলাদেশের পলিটিক্যাল কালচারে বা সংসদীয় কালচারে.. যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উভয় কক্ষের স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতিসহ আরও কয়েকজনের কথা বলা আছে। এই বডিটার হাতে রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ যেমন সব কমিশন, তিন বাহিনী প্রধান থেকে শুরু করে পিএসসি, দুদকসহ আরও যেসব সাংবিধানিক পদ আছে, এগুলো আমরা একমত নই। কারণ কী জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা মনে করি রাষ্ট্রের মধ্যে এক্সিকিউটিভ ফাংশনটাকে এতো বেশি লিমিট করা হবে যে এক্সিকিউটিভ ও প্রধানমন্ত্রীর যে নামেই ডাকি, তাদের আর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এখতিয়ার বা রাষ্ট্র পরিচালনা দায় হয়ে যাবে। অথচ রেন্সপোনসেবিলিটি থাকবে ইলেক্টেড প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের কাছে এবং সংসদের কাছে সেই নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর অথচ তার কাছে তেমন কোনো পাওয়ার দেয়া থাকলো না।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী যিনি হবেন তিনি পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এই প্রস্তাব বিএনপির জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা বলেছি, পরপর দুইবারের বেশি কেউ একজন প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যদি দুই বারের পর একবার গ্যাপ হয় তার পরবর্তীকালে জনগণ যদি সেই দলকে নির্বাচিত করে, সেই পার্টি মেজরিটি পেয়ে যদি ডিসাইড করে তাহলে সেই একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতেও পারেন। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, কেনো আপনারা ধরে নিচ্ছেন যে, সেইম লিডার বার বার হবেন। আমরা অপশনটা রাখতে চাই যে, বাধ্যবাধকতা করা যাবে না।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ৯০ দিনের জন্য ট্যাম্পোরারিলি আন ইলেক্টেড গভমেন্ট চান কেনো? দিস ইজ ডটট্রেইন অব ন্যাসেসিটি। আমাদের পলিটিক্যাল হিস্ট্রিতে ও কালচারে দেখা গেছে উইথআউট কেয়ারটেকার গভমেন্ট আমরা কোনো ইলেকশনই অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু করতে পারি না। যতদিন পর্যন্ত আমরা সেই কালচারে উপনীত না হতে পারব ততদিন পর্যন্ত আমাদের নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেয়ারটেকারের বিধানটা রাখা উচিত। এই ভোটের জন্য আমরা ১৫ বছর আন্দোলনও করেছি।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠকে বসেছিলো।