বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে বিএনপি ৩১ দফা ও জুলাই সনদকে একসঙ্গে দেখবে। জনমত পেলে সাংবিধানিক ও আইনগত সীমারেখা মেনে, দেশের স্বার্থ ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশ গঠন করবে তাদের দল। সম্প্রতি বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। গতকাল মঙ্গলবার বিবিসি বাংলা তারেক রহমানের দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব প্রকাশ করে। সাক্ষাৎকারে সংস্কার, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন তারেক রহমান।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন এমন প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান বলেন, বিষয়টি তো রাজনৈতিক। এটি তো কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। আমরা প্রথম থেকে যে কথাটি বলেছি যে, আমরা চাই, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সফল হোক। অর্থাৎ অনেক কিছুর মত বিভিন্ন বিষয় আছে- যেমন আমরা যদি মূল দুটো বিষয় বলি যে, কিছু সংস্কারের বিষয় আছে, একই সাথে প্রত্যাশিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, স্বাধীন নির্বাচনের একটি বিষয় আছে। মূলত কিছু সংস্কারসহ যেই সংস্কারগুলো না করলেই নয়, এরকম সংস্কারসহ একটি স্বাভাবিক সুষ্ঠু, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যাশা করি যে, উনারা উনাদের উপরে যেটা মূল দায়িত্ব, সেটি উনারা সঠিকভাবে সম্পাদন করবেন। এটাই তো উনাদের কাছে আমাদের চাওয়া রাজনৈতিক দল হিসেবে। আমরা আশা রাখি, প্রত্যাশা করি যে, উনারা করবেন কাজটি সুন্দরভাবে। স্বাভাবিকভাবে এই কাজটির সৌন্দর্য বা কতটুকু ভালো, কতটুকু ভালো বা মন্দভাবে করতে পারছেন, তার ওপরেই মনে হয় সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা যেটাই বলেন, সেটা নির্ভর করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে তারেক রহমান বলেন, এই মুহূর্তে আমার যতটুকু মনে পড়ে সেই সময় পর্যন্ত ওনারা কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক কোনো টাইম ফ্রেম বা কোনো কিছু বলেননি। রোডম্যাপ বলতে যা বুঝায়, আমরা নরমালি যা বুঝে থাকি, এরকম কিছু বলেননি। এবং সে কারণেই শুধু আমার মনের মধ্যেই নয়, আমরা যদি সেই সময় বিভিন্ন মিডিয়া দেখি, বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব দেখি যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে, প্রায় সকলের মনের মধ্যেই সন্দেহ ছিল। আমি মনে করি, উনারা যা বলেছেন উনারা যতক্ষণ পর্যন্ত দৃঢ় থাকবেন, উনাদের বক্তব্যে উনাদের কাজে যত বেশি দৃঢ থাকবেন, ততই সন্দেহ চলে যাবে আস্তে আস্তে।
লন্ডন বৈঠকে নির্বাচনের বাইরে কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর বাইরে তো অবশ্যই স্বাভাবিকভাবে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়েছে। এর বাইরেও উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, জনগণ যদি আপনাদের সুযোগ দেয়, তাহলে আপনারা কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য? এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
গত একবছরে অন্তবর্তী সরকারের মূল্যায়ন নিয়ে তারেক রহমান বলেন, সকল কিছু বিবেচনা করলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, হয়তো উনারা চেষ্টা করেছেন অনেক বিষয়ে। সব ক্ষেত্রে সবাই তো আর সফল হতে পারে না, স্বাভাবিকভাবে ওনাদের লিমিটেশনস কিছু আছে। সেই লিমিটেশনস এর মধ্যে উনারা হয়তো চেষ্টা করেছেন, যতটুকু পেরেছেন হয়তো চেষ্টা করছেন।
এক এগারোর সরকার বা সেনা সমর্থিত সরকারের সেই সময়টাকে ঘিরে মূল্যায়নটা সম্পর্কে তারেক রহমান বলেন, এক বাক্যে বা সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, এক এগারোর সরকার তো একটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত, অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত একটি সরকার ছিল। আমরা দেখেছি যে, কিভাবে তারা সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, বিরাজনীতিকরণ করতে চেয়েছিল। দেশকে একটি অন্ধকার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে দেখেছি যে, খুব সম্ভবত তাদেরই ভিন্ন আরেকটি রূপ অন্যভাবে দেখেছি আমরা ‘ইন দি নেম অফ ডেমোক্রেসি’।
বিএনপি ক্ষমতায় এলে বা সরকার গঠন করতে পারলে ৩১ দফা না কি জুলাই সনদ, কোনটি অগ্রাধিকার পাবে, সে বিষয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট করে তারেক রহমান বলেন, বিএনপি সরকার গঠনের সুযোগ পেলে অবশ্যই ঐকমত্য কমিশনে যেগুলোতে সবাই মিলে একমত হয়েছে, সেগুলোতে প্রথমে জোর দেবে। এর বাইরে যেগুলো ৩১ দফায় থাকবে, সেগুলোও বাস্তবায়ন করব। কারণ, ওটা তো আমাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট। এটাও যেমন পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট, ওটাও আমাদের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায়গুলো নিয়ে বা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে একটা বিতর্ক আছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা কিন্তু কোনো হাইড অ্যান্ড সিক করছি না। যদি আমাদের সে রকম অসৎ উদ্দেশ্য থাকত, মনের ভেতরে থাকত একটা, বলতাম আরেকটা যে ঠিক আছে, ওকে, অসুবিধা নেই। তারপর ইনশা আল্লাহ আমরা সরকার গঠনে সক্ষম হলে আমরা হয়তো করতাম না। তো আমরা যেটা মনে করছি, সেটাই বলছি। সাম্প্রতিক নেপালের ঘটনার উদাহরণ টেনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, তারা কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যাচ্ছে না, তারা বলছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা সংস্কার যা-ই আছে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি এসে সেগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। সেই সূত্র ধরে তারেক রহমান বলেন, তারপরও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সবকিছু বিবেচনা করে রাজনৈতিক দলগুলো বসেছে, অন্তর্বর্তী সরকার আহ্বান করেছে। এখানে যতটুকু হয়েছে, আমরা বলেছি, এখন যতটুকু হয়েছে, যেগুলো শুধু আইন দিয়ে করলে হয়ে যায়, সেগুলো হয়ে যাক। যেগুলোর সাংবিধানিক এনডোর্সমেন্ট লাগবে, সেগুলো আমরা মনে করি যে নির্বাচিত সংসদ হওয়ার পর সেখানে গ্রহণ করাটাই ভালো হবে।
শিক্ষক সমাবেশ : এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বিকালে সোহরাওয়ার্দি উদ্যোগে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে তারেক রহমান বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসলে শিক্ষকদের চাকুরি জাতীয়করণে ‘উচ্চ পর্যায়ের কমিশন’ এবং শিক্ষা ক্যারিকুলাম ঢেলে সাজাতে ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠন করা হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে অবশ্যই রাষ্ট্রের সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা বেষ্টিনি বাড়ানো কিংবা চাকরি স্থায়ীকরণ কিংবা জাতীয়করণের বিষয়টি ইতিবাচক বিবেচনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিশন আমরা গঠন করবো ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন, নৈতিকতা এবং ধর্মীয় সামাজিক মূল্যবোধের আলোকে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকরণে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না যদি না যায় তাহলে এই কম্পিটিশনের বিশ্বে আমাদের দেশ হিসেবে জাতি হিসেবে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন হবে।
বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা, অবসর বয়স ৬৫ বছর নির্ধারণ, ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ ও শিক্ষক-কর্মচারিদে;র চাকুরি জাতীয়করণের দাবিতে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সারা দেশ থেকে কয়েক হাজার শিক্ষক এবং কর্মচারি অংশ গ্রহন করে।
তারেক রহমান বলেন, পারিবারিক পাঠশালার গন্ডি পার হওয়ার পর প্রতিটি শিক্ষার্থীর সামনে শিক্ষকরাই হচ্ছেন আদর্শ রোল মডেল। এ কারণে প্রত্যেক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন এবং প্রিয়জন হয়ে ওঠা কিন্তু অত্যন্ত জরুরি।শিক্ষকরাই যদি রাষ্ট্র এবং সমাজে প্রতিনিয়ত সংসার সম্মান নিয়ে টানা পোড়নে থাকেন তাহলে একজন শিক্ষিকা বা শিক্ষকের পক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে নিজেকে রোল মডেল হিসেবে হয়ত উপস্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তারেক বলেন, রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক সংস্কার কিংবা নাগরিক উন্নয়নে আমরা যত উদ্যোগ গ্রহণ করি না কেন শিক্ষা ব্যবস্থাপনার আধুনিকরণ এবং শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা সম্মান যদি আমরা নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে অবশ্যই আমরা যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি সেটিতে আমাদের কাঙ্খিত সুফল মিলবে না।
তারেক বলেন, দুর্নীতিবাজরা বিত্তবান হলে রাষ্ট্রের সমাজের ভাবমূর্তি কমে। কিন্তু সমাজে শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকলে সমাজের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পায়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতি নামক একটি ব্যাধি রয়েছে। আমি মনে করি, ব্যক্তিগতভাবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকগণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক বিপ্লব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে তারেক রহমান : অন্যদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান বলেন, দল হিসেবে বিএনপি আত্মবিশ্বাসী এবং এককভাবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। তিনি মনে করেন, জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, সেটি ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণতা পাবে না যতক্ষণ না দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি পোশাক রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাতে চান। তার পরিকল্পনা হলো, বাংলাদেশকে অ্যামাজন, ইবে ও আলিবাবার মতো আন্তর্জাতিক ই-কমার্স কোম্পানির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই হাবে রূপান্তরিত করা। ভারতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, বাংলাদেশকে আগে বিবেচনায় রেখে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের দিকে এগোবে বিএনপি। তিনি দুই দেশের বিদ্যমান সম্পর্ককে ‘একতরফা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করা হবে।