ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দীর্ঘ এক বছর ধরে পলাতক রয়েছেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও খুলনা-২ আসনের সাবেক এমপি, শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ জুয়েলসহ নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের স্থানীয় শীর্ষ ১৩ নেতা। এর মধ্যে কয়েকজন সাবেক এমপিও রয়েছেন। পালিয়ে থাকা এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার উপর হামলা ঘটনায় একাধিক মামলাও দায়ের হয়েছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে আইন-শৃংখলা বাহিনী কোন সফলতা দেখাতে পারেনি।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান খুলনা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা। এর মধ্যে রয়েছেন-খুলনা সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, সাবেক এমপি শেখ জুয়েল, ননী গোপাল মন্ডল, এস এম কামাল, আব্দুস সালাম মূর্শেদী, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, রশীদুজ্জামান, আক্তারুজ্জামান বাবু, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুজিত অধিকারী, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কামরুজ্জামান জামাল, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সদর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট সাইফুল ইসলাম, সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির সাইফুল ইসলাম এবং মহানগর যুবলীগ সভাপতি শফিকুর রহমান পলাশ ও সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল সুজনসহ শীর্ষ নেতারা আত্মগোপন করে।

যদিও পরবর্তীতে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় খুলনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ্রকে বিজিবি সীমান্ত থেকে গ্রেফতার করে। এছাড়াও ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় খুলনা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী এবং পৃথক স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় খুলনা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামানকে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী খুলনার শীর্ষ ডেভিলরা এখনো গ্রেফতার হয়নি। বিশেষ করে খুলনা সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, সাবেক এমপি শেখ জুয়েল, ননী গোপাল মন্ডল, এস এম কামাল, আক্তারুজ্জামান বাবু, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানা, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুজিত অধিকারী, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কামরুজ্জামান জামাল, জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সদর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি এডভোকেট সাইফুল ইসলাম, সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির সাইফুল ইসলাম এবং নগর যুবলীগ সভাপতি শফিকুর রহমান পলাশ ও সাধারণ সম্পাদক শাহজালাল সুজনসহ শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন। যদিও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এদের অনেকেই এলাকায় থাকলেও ওই সময় তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়নি। পরবর্তীতে তারা আত্মগোপনে চলে যায়।

এদিকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কেসিসির অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও তার স্ত্রী বাগেরহাট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর নাহার এবং আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট সাইফুল ইসলামসহ শীর্ষ বেশ কয়েকজন নেতাকে বিশেষ স্থানে আশ্রয় দেওয়া হয়। পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

একাধিক সূত্র দাবি করেছে, তালুকদার আব্দুল খালেকসহ বেশ কয়েকজন নেতা ভারতে পালিয়ে গেছেন। তবে এডভোকেট সাইফুল ইসলামসহ অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন। কিন্তু পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ-কেএমপি কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, নিষিদ্ধ দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদেরকে গ্রেফতারের ব্যাপারে কেএমপির তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ আতংকে : খুলনাসহ মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অতিরিক্ত হারে বেড়েছে মাদক বিক্রি, চাঁদাবাজি, হামলা, অস্ত্রবাজি এবং নৃশংস হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা। এসব ধারাবাহিক ঘটনায় সাধারণ মানুষকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি এ বছরের ৪ জুলাই পর্যন্ত মহানগরীতে ৩১টি হত্যা মামলা হয়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে সে-তুলনায় ছিল ১৯। চলতি মাসের প্রথম ৮ দিনেই ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। কুপিয়ে ও গুলীতে জখম করা হয়েছে আরও ৩ জনকে।

মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, মাদক-সংক্রান্ত বিরোধ ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বেশি খুনোখুনি হয়েছে। ১১টি হত্যাকান্ডের নেপথ্যে মাদক ও সন্ত্রাসী গ্রুপের আধিপত্যের বিরোধ পাওয়া গেছে। এছাড়া ইজিবাইক ও ভ্যান চুরি নিয়ে পাঁচ, প্রেমের বিরোধে পাঁচ, পারিবারিক কলহে তিন, নদীতে ভেসে আসে দুটি লাশ, চুরি দেখে ফেলায় একজন, গণপিটুনিতে একজন এবং অন্যান্য কারণে তিনজন নিহত হয়েছেন। ভুক্তভোগীর পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ১ আগস্ট রাতে নগরীর সবুজবাগ এলাকায় ঘরে ঢুকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয় মনোয়ার হোসেন টগরকে। পাঁচ দিন অতিবাহিত হলেও মূল আসামীদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

গত ৩ আগস্ট নগরীর মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ঘের ব্যবসায়ী আলামিন হাওলাদারকে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুর্বৃত্তরা তার গলা কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনায় নিহতের ভাই আওলাদ হোসেন বাদি হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামী করে মামলা করেন। এই মামলায়ও এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। গত ৫ আগস্ট রাত ৮টায় নগরীর সঙ্গীতা সিনেমা হলের সামনে নিষিদ্ধ চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) নেতা শেখ শাহাদাত হোসেনকে গুলী করে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রায় ২৩ বছর কারাভোগের পর গত ৮ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যাসহ অসংখ্য মামলা ছিল। মুক্তির পর তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সারাদেশের মতো খুলনায় পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে নিস্ক্রিয় তারা। এ সুযোগ নিয়েছে সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিরা। অনেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরে আগের অপরাধে জড়িয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীরা। দিন যতই অতিবাহিত হচ্ছে ততই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আলোচিত ১০টি খুনের এজাহার বিশ্লেষণ ও তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীতে সশস্ত্র মহড়া, মাদক-সংক্রান্ত গন্ডগোল ও হত্যাকান্ডে তিনটি সন্ত্রাসী বাহিনী জড়িত। এর মধ্যে রংমিস্ত্রি সোহেল, গোলাম হোসেন ও মনোয়ার হোসেন টগর হত্যাকান্ডে গ্রেনেড বাবুর বি কোম্পানির সদস্য, পঙ্গু রাসেল হত্যায় পলাশ গ্রুপ, অর্ণব হত্যায় বি কোম্পানি ও পলাশ যৌথ এবং আমিন মোল্লা বোয়িং হত্যাকান্ডে আশিক গ্রুপের সদস্যরা জড়িত। এ ছাড়া তদন্তে বড় শাহীন ও মাহাবুব হত্যায় জেলে থাকা চরমপন্থি নেতাদের অনুসারীদের নাম উঠে এসেছে। আলামিন হাওলাদার হত্যাকান্ডেও একই গ্রুপ জড়িত।

এ ব্যাপারে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, ২৭টি হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এজাহারভুক্ত বেশির ভাগ আসামী কারাগারে। পলাশ বাহিনীর প্রধান শেখ পলাশ, সেকেন্ড ইন কমান্ড কালা লাভলু, নূর আজিম বাহিনী প্রধান নূর আজিম, আশিক বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড সাগরসহ ৫৪ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’ একের পর এক হত্যাকান্ডে আতঙ্কিত খুলনা মহানগরবাসী। সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার কড়া সমালোচনা করছেন।