শুধুই নির্বাচন, নাকি একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ ভোটারদের মাঝে। তারা বলছেন, একটি নির্বাচনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে লেভেল ফিল্ড থাকা। প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকাও জরুরি। কিন্তু ভোটের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করা হলেও এখনো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো অনুপস্থিত। ইসির কর্মকর্তারা নিজেরাই স্বীকার করছেন, তাদের সামনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। সেটি এখনো দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন জরিপেও সেগুলো ফুটে উঠছে। তারা এখনো ঠিকই করেননি আদৌ ভোট দিবেন কি-না। দিলেও কাকে ভোট দিবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটারদের আস্থায় আনতে না পারলে কখনোই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যাবে না। জনমতকে উপেক্ষা করে ভোট হলে সেটি শুধু নির্বাচনই হবে, তাকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য বলা যাবে না। একইসাথে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে জনগণের অসন্তোষ যে কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, তা সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের পরিণতির ঘটনাগুলো স্মরণ করিয়ে দেন।
সূত্রমতে, বাংলাদেশে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছাড়া সব কটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো নির্বাচন যেকোনো সময়েই অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু যেনতেন একটা নির্বাচন করলে কি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে? আবার একটা যেনতেন নির্বাচন করা হলে তা ‘জুলাই ২০২৪’ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। ১৯৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখা ভেঙে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছিল পতিত সরকার। তারপর যে নির্বাচন করেছে, তা শেষ পর্যন্ত তাদের নির্লজ্জভাবে বিদায় নিতে বাধ্য করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমানে কি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের অনুকূল পরিস্থিতি আদৌ আছে?
সূত্রমতে, গণতন্ত্র উত্তরণের মূল ভিত্তি হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এই ভিত্তিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ইসি, রাজনৈতিক দল, ভোটারদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো উঠে এসেছে, তাতে জাতির সামনে এক গভীর সংকটের চিত্র ফুটে উঠছে। অনেকেই বলছেন, একটি ভালো নির্বাচন শুধু ভোটের প্রক্রিয়ার ওপর নয়, এটি রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অনাস্থা ও সমঝোতার অভাব নির্বাচনের পরিবেশকে জটিল করে তোলে। ‘জুলাই সনদ’-এর মতো বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হলে নির্বাচনের সময় সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একটি বড় বাধা। সব রাজনৈতিক পক্ষকে আস্থায় নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করাই এখন সরকারের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে। সেই হিসাবে সময় বাকি ছয় মাসের মতো। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনই রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঙ্গা হয়ে উঠার কথা, কিন্তু সেটি এখনো দেখা যাচ্ছে না। প্রচলিত নিয়মে নাকি পিআর পদ্ধতিতে ভোট হবে, এনিয়ে এখনো চলছে আলোচনা। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলে অনেকেই আশংকা করছেন। বিশেষ করে ফ্যাসিস্টরা এখনো প্রশাসনসহ সর্বস্তরে বহাল। তাদের বিশাল কর্মী বাহিনী ধরা ছোয়ার বাইরে। নির্বাচনে আট লাখের বেশি ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা প্রয়োজন হবে। এর একটি বড় অংশই আসে স্কুল শিক্ষকদের থেকে। বিগত তিন নির্বাচনের ভোটগ্রহণের সঙ্গে জড়িতদের বাদ দিতে গেলে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংকট তৈরি হবে। কিন্তু এই অংশটির বেশির ভাগই ফ্যাসিস্ট সমর্থক বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বেশি আশঙ্কা প্রকাশ করছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। বরাবরই দেখা যায়, নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তত বেশি অবনতি হতে থাকে। এ বছর পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ধারণা করা হয়, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা যায়নি। তারা দেশকে বিশৃঙ্খল করতে এসব ব্যবহার করতে পারে। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে ৪৫ হাজারের বেশি ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাহিনীর প্রহরার ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্র সক্ষম কি না? গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে মানসিক অবস্থা, তাতে নির্বাচনের মতো একটি মহাযজ্ঞ সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন। তার মানে কি নির্বাচন হবে না? অবশ্যই হতে হবে বরং একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি। আর তা হলে সাধারণ জনগণের ভোটদান থেকে বিরত থাকার আশঙ্কা থেকে যাবে।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে কোনো ব্যতিক্রম হলে এর দায়ভার কে নেবে? তা নিতে হবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকেই। একটি গণজাগরণের পর যে নির্বাচন, তার ফলাফল অনেক সময় চমকপ্রদ হতে পারে, যেমন ১৯৯১ সালের নির্বাচন। সেই সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিএনপি বড়জোর ১০টি আসন পেতে পারে। কিন্তু ফলাফল হলো, বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগের দিনও কেউ কল্পনা করেননি যে শেখ হাসিনা ঢাকা-১০ (রমনা-তেজগাঁও) আসনে মেজর মান্নানের কাছে এবং ঢাকা-৭ (কোতোয়ালি-সূত্রাপুর) আসনে সাদেক হোসেন খোকার কাছে পরাজিত হবেন। কিন্তু জনগণ তাদের নীরব রায় দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টে দৃশ্যমান অধিকতর সমর্থক থাকার পরও হয়েছে নীরব ভোটবিপ্লব। এবারো অনেকের কর্মকান্ড ও বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় এসেই গিয়েছে। কিন্তু ফলাফল নির্ভর করছে জনমতের উপর। সেটি ১৯৯১ সালের পুনরাবৃত্তিও হতে পারে। কারণ অভূত্থান পরবর্তী সময়কার রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন জানতে পারছে।
সূত্র মতে, ২০০১ সালের পর থেকে দেশে কোনো নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন হয়নি। ভোটাররাও তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। সে সময় যাদের বয়স ছিল ১৮ বছর, তাদের বয়স আজ ৪৩ বছর। ২০২৫ সালে কনিষ্ঠ ভোটারদের জন্মবর্ষ ছিল ২০০৭ সাল। এর মানে হচ্ছে ১৮ থেকে ৪৩ (জন্মবছর বয়স পর্যন্ত) যাদের বয়স, তারা প্রথমবারের মতো একটি অবাধ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পাবেন। ১৯৮৩ থেকে ২০০৭ সাল, এই সময়ে যাঁরা জন্মেছেন, তাদের ভোট সরল সমীকরণে ভাগাভাগি করলে তা তাত্ত্বিকভাবে ঠিক হবে, কিন্তু বাস্তবে এর চিত্র ভিন্ন হতে পারে। ১৮ থেকে ৪৩ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা ৬৪ শতাংশের বেশি। সুষ্ঠু ভোট হলে এই ৬৪ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি ও তুলনামূলক বেশি হবে। ৪৩ বছরের বেশি বয়স্ক ভোটারের সংখ্যা মাত্র ৩৫ শতাংশ। তারা অনেকটা স্থায়ী মতাদর্শের মানুষ। কিন্তু নির্বাচনে কারা জিতে আসবেন, তা নির্ভর করবে ১৮ থেকে ৪৩ বছর বয়সী ভোটারদের ওপর। কিন্তু সব কিছুই নির্ভর করবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপর। যদি আবারো ফ্যাসিবাদী কায়দায় নির্বাচন হয়, তাহলে ভোটের এই হিসেব করাটা হাস্যকর।
এসব ভোটার আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের চিত্র সরাসরি দেখেছেন। অধিকন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় রেজিস্ট্রেশন স্থগিত। তার মানে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ হচ্ছেনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহসীন আহমেদ বলেন, এই নির্বাচন সবার জন্যেই চ্যালেঞ্জের। কারণ যারা গত দুই দশক ধরে ভোট দিতে পারেন নি, তারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষা করছে। যারা নিজেদের অতি আত্নবিশ্বাসী ভাবছেন, তাদের ধারণা ভুলও হতে পারে। ভোট মানেই কোনো পক্ষের জয়, বিষয়টি এত সরল না-ও হতে পারে। অভূত্থান পরবর্তী বিশৃঙ্খলা ও নিজেদের মধ্যে হানাহানি, চাদাবাজি, দখলদারির বিষয়গুলো এবারের নির্বাচনে ফ্য্াক্টর হয়ে দাঁড়াবে। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনের আগেই যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে অতীতের পরিণতিই সবাইকে ভোগ করতে হবে।
রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান ভালো নির্বাচনের জন্য ভোটের সঙ্গে জড়িত সব পক্ষের মধ্যে বোঝাপাড়া ঠিক রাখায় জোর দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন,আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে আমাদের যে প্রার্থী, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সরকার এসবকে কেন্দ্র করে একটা কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটা কতটা চমৎকারভাবে নির্বাচন কমিশন বোঝাপড়া তৈরি করতে পারবে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নম্বর ওয়ান চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। আসলে ভোটারদের দোষ দিয়ে লাভ নাই।
বিএনপি বলছে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ‘উদ্বেগ’ থাকলেও তারা দুশ্চিন্তার কিছু দেখছে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ইসি নির্বাচনের প্রস্তুতি যথাযথভাবে নিচ্ছে। এখনও তাদের কিছুটা উদ্বেগ আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে। তবে সেটির উন্নতি ঘটবে বলে আমরা মনে করি।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, তফসিল ঘোষণার পরই নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ বাড়বে। তখন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির বিষয়টিও সামনে আসবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, পূর্ণাঙ্গ সংস্কার না হলে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হবে। মানুষের মধ্যে যদি নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয় তাহলে সেই নির্বাচনে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করবে কি না সে শঙ্কা থেকে যায়। সংস্কারের ভিত্তিতে এই নির্বাচন হতে হবে। যেনতেন নির্বাচন জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে পারবে না। তিনি বলেন, আমরা চাই একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। উৎসবমুখর নির্বাচন। এর আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কারের বিষয়ে অনেকগুলো বিষয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য পোষণ করেছে। এ সংস্কারের ভিত্তিতেই নির্বাচন হতে হবে।