এম এ আর মশিউর, যশোর : জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী শাসনের পতনের পর যশোরের রাজনৈতিক চিত্র বদলে গেছে। জেলার ছয়টি আসনের জাতীয় নির্বাচনের সমীকরণে বড় পরিবর্তন এসেছে। অতীতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও এবার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
জামায়াতের নেতাদের মতে, জনগণের আস্থা, তৃণমূলের সংগঠিত কাঠামো এবং অতীতের সুনামের ভিত্তিতে এবার তারা একাধিক আসনে জয়ী হতে পারবে। প্রধান দুই দলের বাইরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কিছু সাংগঠনিক উপস্থিতি থাকলেও কোনো আসনে তাদের জয়ের সম্ভাবনা কম। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সাংগঠনিকভাবে এখনো দুর্বল, আর জাতীয় পার্টি কার্যত বিলুপ্তির পথে। বাম রাজনীতিরও আর দৃশ্যমান প্রভাব নেই। সার্বিকভাবে যশোরের ছয়টি আসনেই বিএনপি-জামায়াত সরাসরি লড়াই হবে বলে স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
যশোর-১ (শার্শা) ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন জামায়াতের মাওলানা আজীজুর রহমান। এবারও তাকে প্রার্থী করেছে দলটি। তিনি সবসময় জনগণের কল্যাণে নিবেদিত থেকে এলাকার উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সড়ক যোগাযোগ ও কর্মসংস্থান খাতে উন্নয়নকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। জনসাধারণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং স্বচ্ছ নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে তিনি একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে বদ্ধপরিকর। জনগণের ভালোবাসা ও সহযোগিতা নিয়েই তিনি যশোরকে একটি উন্নত, আধুনিক ও মডেল অঞ্চলে রূপান্তর করতে চান। তার নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষের দাবি মাওলানা আজীজুর রহমান নির্বাচিত হলে সীমান্ত এলাকায় মাদক ও চোরাচালান দমন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন হবে। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন মফিকুল হাসান তৃপ্তি, খায়রুজ্জামান মধু, আবুল হাসান জহির ও নুরুজ্জামান লিটন। তবে বিএনপির কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত শক্ত অবস্থান নিতে চায়।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) জামায়াত প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ডাক্তার মোসলেহ উদ্দীন ফরিদ। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও এলাকায় সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর নির্বাচনী অঙ্গীকারে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও শিক্ষা সুযোগ বৃদ্ধি। ইতোপূর্বে তিনি ৫০ হাজার মানুষের ফ্রী চিকিৎসা দিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। ডা. মোসলেহ উদ্দীন ফরিদ ১৯৬১ সালে যশোর জেলার খড়কি পীরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম শরিফ হোসেন স্যার ছিলেন যশোর এমএম কলেজের অধ্যক্ষ এবং মাতা শিক্ষিত ও নৈতিকতাবান একজন মহীয়সী নারী। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি সম্পন্ন করার পর তিনি ১৯৮৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে গিয়ে ডিগ্রি লাভ করেন এবং নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল শিক্ষায় পিজিসি সম্পন্ন করেন। যুক্তরাজ্যের এনএইচএস কর্তৃক ২০১২ সালে এক্সলেন্স অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত এই চিকিৎসক উন্নত দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। ছাত্রজীবনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন তিনি। বর্তমানে সামাজিক ও মানবিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন। বিএনপির পাঁচজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে সাবিরা নাজমুল মুন্নি ও মিজানুর রহমান খান এগিয়ে আছেন।
যশোর-৩ (সদর) জামায়াত প্রার্থী ভিপি আব্দুল কাদের, যশোর সরকারি এমএম কলেজের সাবেক ভিপি ও ব্যবসায়ী। তিনি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শহরের যানজট নিরসন এবং যুব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আব্দুল কাদের ১৯৬৩ সালের ৫ জানুয়ারি যশোর সদর উপজেলার খোলাডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যশোর জিলা স্কুল ও এমএম কলেজে পড়াশোনা শেষে ১৯৮৩ সালে অর্থনীতিতে অনার্স এবং ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৮ সালে এলএলবি সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এবং পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যুক্ত হয়ে এমএম কলেজের ভিপি ও বৃহত্তর যশোর জেলার সেক্রেটারি দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত জীবনে ব্যবসায়ী হিসেবে সাফল্য অর্জন করে বর্তমানে গার্মেন্ট ব্যবসায় সম্পৃক্ত আছেন। ২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে ২০১০ সালে রোকন হন। সাংবাদিকতা জীবনে দৈনিক স্ফূলিঙ্গ ও দৈনিক সংগ্রামে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিএনপির অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের সঙ্গে সরাসরি লড়াই হবে তাঁর। জামায়াতের স্থানীয় নেতারা বিশ্বাস করেন, কাদেরের সততা ও নেতৃত্ব গুণ তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করবে।
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া, অভয়নগর ও সদরের বসুন্দিয়া) যশোরের জেলা আমির অধ্যাপক গোলাম রসুলকে প্রার্থী করেছে জামায়াত। তিনি কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অধ্যাপক গোলাম রসুল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ও যশোর জেলা আমীর। তিনি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে এক শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন বাঘারপাড়া সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসায় এবং পরবর্তীতে নড়াইল শাহাবাদ মজিদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল সম্পন্ন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি যশোরের হামিদপুর আল হেরা কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং বর্তমানে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে জামায়াতে যোগ দিয়ে যশোর জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি যশোর জেলা জামায়াতের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষা ও রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-েও সক্রিয়। যশোর ফাউন্ডেশন, আল হেলাল ট্রাস্ট ও যশোর সংস্কৃতি কেন্দ্রসহ নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে জনসেবায় নিয়োজিত। শিক্ষিত, মার্জিত ও সজ্জন ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিএনপির শক্ত প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার টি এস আইয়ুবের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন অভয়নগর বিএনপির সভাপতি ফারাজী মতিয়ার রহমান।
যশোর-৫ (মণিরামপুর) জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী আইনজীবী গাজী এনামুল হক। তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি দমন, সড়ক উন্নয়ন এবং সেচ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের অঙ্গীকার করেছেন।
এলাকার দীর্ঘদিনের ভোগান্তি ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধানকে প্রধান অঙ্গীকার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মানুষের জলাবদ্ধতা দূর করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চান তিনি। পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে সর্বদা পাশে থেকে তিনি মনিরামপুরকে একটি বাসযোগ্য, উন্নত ও সমৃদ্ধ এলাকায় রূপান্তর করতে চান। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবালসহ কয়েকজন নেতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তাঁর।
যশোর-৬ (কেশবপুর) জামায়াতের অধ্যাপক মো. মুক্তার আলী দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে সততা ও মানবিকতার জন্য পরিচিত। তিনি নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে নিরপেক্ষ প্রশাসন, শিক্ষা খাতের সংস্কার এবং যুবকদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষ প্রকল্প নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বিএনপির আবুল হোসেন আজাদ ও আব্দুস সামাদ বিশ্বাস।
অন্যান্য দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। জামায়াতের জেলা নেতারা বলছেন, জনগণ পরিবর্তন চায়, আর সেই পরিবর্তনের জন্য সংগঠিত, আদর্শিক ও সৎ নেতৃত্ব হিসেবে তাঁরা প্রস্তুত।