জুলাই গণঅভ্যূত্থানের চেতনা, ঐক্য ও প্রতিজ্ঞা সংরক্ষণের প্রত্যয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে ছাত্রদের আরেকটি রাজনৈতিক দল ‘ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ’ (আপ বাংলাদেশ)। বলা হচ্ছে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও সামাজিক চুক্তির পুনর্বহাল, জুলাইয়ের প্রকৃত আকাঙ্খার বাস্তবায়ন এবং বৈষম্যহীন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে গঠিত নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ।
গতকাল শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দলটির আহ্বায়ক কমিটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ওসমান পাটোয়ারীর বাবা শফিউল আলম। ঘোষণা করা হয়েছে ৮২ সদস্যের নাম। আহ্বায়ক কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি আলী আহসান জুনায়েদ আহ্বায়কের দায়িত্বে রয়েছেন। সদস্য সচিব করা হয়েছে আরেফিন মুহাম্মদ হিজবুল্লাহকে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাফে সালমান রিফাতকে প্রধান সমন্বয়কারী, নাঈম আহমেদকে সংগঠক এবং শাহরীন ইরাকে মুখপাত্র ঘোষণা করা হয়েছে।
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অংশ নেন। এ সময় আহত এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। শহিদের পরিবারদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন। শহীদ ওসমান পাটোয়ারীর পিতা আব্দুর রহমান, শহীদ ওয়াসিম আকরামের পিতা শফিউল আলম,শহীদ আসহাবুল ইয়ামিনের পিতা মহিউদ্দিন ,শহীদ জাবিরের পিতা কবির হোসেন ,শহীদ ডা. সজিবের বোন স্বর্ণা, পিলখানা শহীদ সুবেদার নুরুল ইসলামের ছেলে হান্নান,শহীদ নাফিজার পিতা আবুল হোসেন ,শহীদ যোবায়েরের পিতা কামাল উদ্দিন ,শহীদ আব্দুল্লাহ কবীরের ভাই রাজু,শহীদ নূরের পিতা আবুল বাশার,শহীদ সোহেলের স্ত্রী মারইয়াম রাহিম
*বিএফ শাহীনের শহীদ আহনাফের বাবা-মা, শহীদ ফায়য়াজের ভাই সহিদুল ,শহীদ নাফিজের বাবা গোলাম রহমান
*শহীদ রমিজ উদ্দিনের বাবা রকিবুল আহমেদ ,শহীদ আরাফাতের ভাই হাসান আলী ,শহীদ সাইদুল ইসলামের স্ত্রী শিল্পী ,শহীদ সোহানের স্ত্রী সম্পা আক্তার ,শহীদ কবিরের ভাই মিঠুন হাসান ,শহীদ রুবেলের স্ত্রী রুপা,শহীদ সজলের মা রুনা,
নতুন এই প্ল্যটফর্মের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, জুলাইকে কেন্দ্র করেই আমাদের এই রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। জুলাইয়ের শপথে আমরা আজ শপথ নিচ্ছি। শহীদ পরিবারের প্রতি আমাদের শপথ তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই হবে আমাদের রাজনীতি। এছাড়া অন্য কোনও রাজনীতি আমরা করবো না। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই আমাদের রাজনীতি।
তিনি আরও বলেন, মূলত এটা একটা পলিটিক্যাল প্রেসার গ্রুপ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। আমরা এটার প্রয়োজনীয়তা মনে করেছি এ জন্য যে জুলাই অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট সেটি আস্তে আস্তে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যেও একটা হতাশা তৈরি হচ্ছে। এই অভ্যুত্থানকে আমরা যদি ডেলিভার্ট রাখতে না পারি তাহলে নতুন রাজনীতি বলতে আমরা যা বুঝেছি তা আর পরিণত হবে না। সুতরাং আমরা মনে করেছি জুলাইয়ের স্পিরিটকে কেন্দ্র করে, জুলাইয়ের দাবিকে কেন্দ্র করে একটা প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন। আমরা আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একটা কার্যকর অবস্থান নিতে চাই। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, সমাজের সর্বস্তরে যোগ্য ও নৈতিক নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সুবিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশ পুনর্গঠন এই প্ল্যাটফর্মের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, পিলখানা, শাপলা ও জুলাই গণহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধের বিচার, ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ এবং জুলাইয়ের আহত যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার দাবিতে জনমত ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা এই প্ল্যাটফর্মের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে বিবেচিত হবে।
দলটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ ( ইউপিবি/আপ বাংলাদেশ) জুলাই গণঅভ্যুত্থান শক্তির একটা রাজনৈতিক উদ্যোগ। বাংলাদেশে মধ্যম ডানপন্থী ধারার। রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করে জুলাই অভ্যুত্থান কে বিপ্লবে রুপান্তর করাই এর উদ্দেশ্য। রক্তরাঙা জুলাই চেতনার-অনুপ্রেরণার ভিত্তিতে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের মূলৎপাটন, আধিপত্যবাদ বিরোধী, বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন এবং দলীয় আভ্যন্তরীণ পরিবেশ থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পর্যন্ত সুস্থ ও টেকসই গণতান্ত্রিক চর্চা চলমান রাখতে চাই আমরা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী, ধর্মবিদ্বেষের বিপরীতে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের পক্ষে আমাদের বুলন্দ আওয়াজ থাকবে সবসময়ই আপ বাংলাদেশ সংগঠনের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে সামনে এগিয়ে যেতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। ৪ টি রাহুগ্রাস থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার থাকবে এই প্ল্যাটফর্মের প্রস্তাবনায়--- ফ্যাসিবাদ, আধিপত্যবাদ, ধর্মবিদ্বেষ এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান শক্তির এই প্ল্যাটফর্মটি।
জনমত গঠন ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বিষয়ে বলা হয়-- পিলখানা, শাপলা ও জুলাই গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত করা। সকল জুলাই শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, স্থায়ী পুনর্বাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আজাদী, এবং শরীরিক-মানসিকতা স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। আওয়ামীলীগ আমলে সকল গুম, হত্যা, অবিচারসহ গণহত্যা পিলখানা, শাপলা হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক চাপ দেওয়া। আপমর বাংলার সংস্কৃতি ও বাঙালি মুসলমানদের সাংস্কৃতি পূর্ণজীবিত করে, বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরে আনতে কাজ করা। সকল আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তিতে দীর্ঘ মেয়াদী কাজ করা। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গৌরবান্বিত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে উদ্যমী হওয়া। সকল ধর্মের মানুষের আচার-অনুষ্ঠানকে সম্মান প্রদর্শন, নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা। মুসলমান, হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীদের মাঝে; কিংবা পাহাড়ি ও সমতলের মানুষের মধ্যে সকল ধরনের বৈষম্য দূর করা। বাংলাদেশের নারী ও কিশোরীদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রদান করা, শালীন সৌহার্দ্যমূলক পরিবেশ তৈরি করা এবং রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সকল সেক্টরের নারীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা। সকল ধর্ষণ মামলার দ্রুত বিচার, ধর্ষকের সর্বো”চ বিচার নিশ্চিতকরণ করতে জনগনকে সাথে নিয়ে কাজ করে যাওয়া। দেশের সকল সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, পাহাড়ি, জেলে সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক মুক্তি নিশ্চিত করতে প্রাইভেট সেক্টরের সাথে সমন্বয় করে টেকসই অর্থনৈতিক আজাদি নিশ্চিত করতে অব্যাহতভাবে কাজ করে যাওয়ায়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও নৈতিক শিক্ষার সমন্বিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা।
শিক্ষা, সরকারি-বেসরকারি চাকরি, স্বাস্থ্যসহ সকল খাতে সব ধরনের কোটা, বৈষম্য দূর করে মেধাকে প্রধান্য দিয়ে নারী-পুরুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা। বেকার যুব সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে নতুন নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে ‘উইন-উইন’ ভিত্তিতে সম্প্রসারণ করা এবং রাষ্ট্রকে যেকোনো ধরনের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি থেকে দূরে রাখতে চাপ সৃষ্টি করা। একই সঙ্গে, বিদ্যমান যেসব আধিপত্যমূলক চুক্তি রয়েছে, সেগুলো বাতিল বা সংশোধনের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, সার, সেচ ও বিদ্যুতের নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে কৃষিতে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলা। জুলাইয়ের অন্যতম প্রধান সহযোদ্ধা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। তাদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত রেমিট্যান্স যাদু আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তাই সকল প্রবাসী বাংলাদেশি ভাইবোন ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, এয়ারপোর্টে তাদের যেসকল অপ্রয়োজনীয় ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়, সেগুলা দূর করা ও যাত্রীদের কষ্ট লাঘবে কার্রযকরী ব্যবস্থা গ্রহণে সরকাররে চাপে রাখা। ৬৮ হাজার গ্রামের দেশ বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষায় গ্রাম-প্রতিরক্ষা কমিটি গড়ে তুলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সীমান্ত প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীকে সহযোগিতা করা। ছিন্নমূল মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় ও প্রাইভেট উদ্যোগের সমন্বয়ে মাথাগোঁজার আশ্রয় নিশ্চিতে অব্যাহতভাবে কাজ করে যাওয়া।